অভিমত
সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী, অসহিষ্ণু সময়
আমাদের ধারণা যে কেবল আমরাই সঠিক, অধিকার আছে কেবল আমাদের এবং নিজেদের ভাবনা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটাকে কিছুই মনে করি না। এর ফলে এমন একটি অসহিষ্ণু পরিসর তৈরি হয়েছে যার ভেতরে ভাস্কর্য প্রস্তুতকারী এবং নামাজি কেউই নিরাপদে নেই।
রোগটা অনেক গভীরের, এটা ভাস্কর্য রাখা আর গড়ার বিষয় নয়, এটা অসহিষ্ণু কীভাবে প্রধান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নির্ধারক হয়ে ওঠে তার প্রকাশ। এটাও হতে পারে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্বের কারণে এটা ভাঙা হয়েছে। তাতে করে কিন্তু এই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ আরো প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়।
২. অনেকেই বলবেন যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্কের পরই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এটা বিশেষ করে তাদের বক্তব্য যারা হেফাজত জাতীয় দর্শন অপছন্দ বা ভয় করে। এর একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে যে এত দিন পর্যন্ত তাদের ধারণা ছিল যে আওয়ামী লীগের চিন্তাভাবনার ওপর তাদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগ হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করে বুঝিয়ে দিল যে দল যার, ভাবনা তার।
পছন্দ করেন আর নাই করেন আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্ত রাবীন্দ্রিক ছায়াতলে প্রস্তুত বুদ্ধিজীবীদের ওপরে নির্ভর করে না। এর কারণে এ সব বুদ্ধিজীবীর মনে দারুণ সংকট তৈরি হয়েছে। তারা কোনো দিনই নিজের পরিসর তৈরি করেনি। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার যে দায়িত্ব সেটা তারা পালন না করে কোনো না কোনো দলের পেছনে দৌঁড়িয়েছে। এর ফলে পছন্দসই দল যখন ক্ষমতায় থাকে তাদের দিনকাল ভালো যায়, আর যখন থাকে না তখন তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
বর্তমানে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কিছুটা দুর্দিন চলছে। কারণ তাদের দলের সহায়তা ছাড়া একা চলার ক্ষমতা নেই। এখন তাদের হেফাজত ঘনিষ্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলাফেরাও তাদের অসুবিধার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ‘কই যাই, কই যাই’ করতে করতে তারা না পারছে কোথায় যেতে, না পারছে স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে। সুবিধাবাদের এই চরম শিক্ষাটা তারা টের পাচ্ছে।
৩. অন্য দিকে আছে তারা যারা মনে করে হাসিনা বাধ্য হয়ে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। কারণ তা না হলে তারা বিএনপি-জামায়াতকে আটকাতে পারবে না। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে তারা বারবার আঙুল তুলে দেখায়। এনাদের ধারণা যে বিজয় খুব নিকটে এবং যা ঘটছে তা একটি দুর্বল সরকার প্রধানের অবস্থার বিবরণ। দুর্ভাগ্যবশত এদের কপালে এই নিয়ে তৃতীয়বার একটা বড় ধরনের আঘাতের সংকেত দেখা যাচ্ছে। কারণ নানাভাবে চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষ সবল হতে পারছে না তাদের দুর্বলতার কারণে।
৪. গত ২০ বছরের ইতিহাসে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক অর্জন হচ্ছে অসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেটা কোনো ধরনের রাশ টানতে পারে সরকারি কোনো সিদ্ধান্তের ওপর। আওয়ামী লীগের জন্য বিপদ হতে পারে এমন কোনো শক্তি বাংলাদেশে টেকার মতো এই মুহূর্তে নেই। তাই এই অসহিষ্ণু সময়ে ভাস্কর্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করে কেউ নিজের উপস্থিতি ও ক্ষমতা ঘোষণা করতে চেয়ে থাকে, তাদের জীবনে কি আছে সেটা একটু অনুমান করে নিবেন।
৫. আমাদের এই কাল অসহিষ্ণুকাল। কারা টিকবে বলা যায় না, তবে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একাংশ সুবিধার জন্য তেলের ব্যবসায় যে দীর্ঘদিন ধরে মেতেছেন তার সঙ্গে যে একটু-আধটু বিষও থাকে সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা ভেবেছিলেন, দলের কোলে বসে তারা প্রশংসা চর্চা করে যাবেন এবং তার বদলে সুবিধা পেতে থাকবেন।
অসুবিধা হলো, হাসিনা তাদের ওপরে নির্ভরশীল নন, ঠিক যেমনিভাবে খালেদাও নির্ভর করেন না বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের ওপর। বুদ্ধিজীবী আর পরজীবী যে এক জিনিস নয় সেটা যখন মানুষ ভুলে যায় তখন এই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।
অন্য যে শক্তিটা হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতা দেখে এত খুশি হচ্ছে যে ইসলাম এলো এলো ভেবে চারিদিকে, তাদের মনে রাখা দরকার যে ইসলাম এখানেই আছে। বাংলাদেশের মানুষকে ভাস্কর্য ভেঙে, মানুষকে জবাই করে ইসলাম শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এর আগেও হয়েছে। বড় আকারে করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ছোট আকারে ইদানীংকার জঙ্গিরা। দুজনেরই কী হাল হয়েছিল এবং হচ্ছে ওটা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। এ দেশের মানুষ ধার্মিক, দয়া করে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
৬. অসহিষ্ণুতা একটি সময়ের ব্যাধি। এর একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে একটি সহিষ্ণু সমাজ, পরিসর, রাজনীতি, চিন্তা এবং আত্মনির্ভরশীল মানসিকতা। দুই চরমপন্থীদের জন্য সহিষ্ণুতার শিক্ষা অত্যাবশ্যকীয়।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক