আন্তর্জাতিক
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উত্তর কোরিয়া কি হুমকি?
নানা ইস্যুতে বিশ্বব্যবস্থায় উত্তেজনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া ইস্যুটি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি অসম অবস্থান যেকোনা মুহূর্তে বিশ্বে চরম অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি অব্যাহত রেখেছেন। এরই মধ্যে সিরিয়া সরকারের ওপর তিনি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছেন। আফগানিস্তানেও আইএস জঙ্গিদের ওপর অপারমাণবিক সবচেয়ে বড় বোমা বিস্ফোরণ এরই মধ্যে ঘটিয়েছেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি এক ধরনের বেপরোয়া নীতি অবলম্বন করে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু বিশ্বশান্তি বিনষ্টের দিকে কোনো কার্যক্রম আশা করা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখছে। উত্তর কোরিয়াকে থামানো না গেলে তারা যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক অস্ত্র হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করে ফেলতে পারে বলে মনে করছে মার্কিন প্রশাসন। গত ৫ এপ্রিল জাপান সাগরে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে উত্তর কোরিয়া। এর আগে ৬ মার্চ উত্তর কোরিয়ার চীন সীমান্তের নিকটবর্তী তংচ্যাং-রি অঞ্চল থেকে জাপান সাগরে চারটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। তখন দক্ষিণ কোরিয়ার বার্তা সংস্থা ইয়োনহ্যাপ জানায়, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সম্ভবত আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং জাতিসংঘ বেশ কয়েকবার নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ওই কার্যক্রম থেকে সরে আসেনি উত্তর কোরিয়া। বিষয়টি এখন পারস্পরিক চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে চলে গেছে।
বিশ্বের মোড়ল হিসেবে পরিচিত একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক হামলা চালাবে, এমনটি চিন্তাই করা যায় না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিন্তাভাবনা ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে নানা ধরনের দ্বিধা-সংশয় শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত কিম জং-উনের নেতৃত্ব নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্নও রয়েছে। ফলে উভয়ের মধ্যে অধিকতর সংকট তৈরি হওয়ার বিশেষ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে এ বিষেয় চীন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। আগে থেকেই চীন উত্তর কোরিয়ার ভালো বন্ধু হওয়ায় এ বিষয়ে তাদের যথেষ্ট চিন্তা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়া যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না, এমনটা সহজেই চিন্তা করা যায়। অবশ্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এমনটিই উল্লেখ করেছেন। মূলত উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বার্তাগুলো যুদ্ধের চূড়ান্ত ইঙ্গিত বহন করে। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট বার্তায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একা ব্যবস্থা নিতে ভীত নয়। তিনি আরো বলেন, চীন সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিলে ভালো। না হলে তাদের ছাড়াই আমরা সমস্যার সমাধান করব।
শুধু চীন কেন, বর্তমানে কেউই চায় না যে কোনো যুদ্ধ শুরু হয়ে যাক। বিশেষত, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক যুদ্ধের যে নির্মমতা ও ভয়াবহতা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে, এর পুনরাবৃত্তি হোক—শান্তিকামী মানুষ তা প্রত্যাশা করে না। তাই চীনের আবেদন, ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি।’ কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘটনায় দেশটিকে একটি শিক্ষা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করে বলেছেন, দেশটির পারমাণবিক হুমকি মোকাবিলায় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি আবারও মনে করিয়ে দেন, ‘উত্তর কোরিয়াকে সহ্য করার সময় শেষ। যুক্তরাষ্ট্র আর দেশটিকে সহ্য করবে না।’ ১৭ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ায় সফরকালে পেন্স এ হুঁশিয়ারি দেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাই, উত্তর কোরিয়া তাদের অবস্থান থেকে সরে আসুক। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত।’
দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্রের এক মাথাব্যথার নাম উত্তর কোরিয়া। সেখানকার শাসকগোষ্ঠীকে বদলাতে, দুর্বল করতে অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের অবরোধ আরোপ অব্যাহত আছে। বলতে গেলে, একঘরে করে রাখা হয়েছে দেশটিকে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মিলে যৌথ সামরিক মহড়াও করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে। কিন্তু কিছুতেই উত্তর কোরিয়াকে বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, পারমাণবিক সমরাস্ত্রের সম্ভার বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর অর্থ, উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উন সাদ্দাম কিংবা গাদ্দাফির মতো নিজেকে অসহায়ভাবে শেষ করতে চান না যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
উল্লেখ্য, উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা আন্তর্জাতিক আইনসম্মত কি না, সেটিও ভাবার বিষয়। আন্তর্জাতিক আইনে কোথাও এর কোনো নিষেধ নেই। প্রতিটি দেশের সার্বভৌম অধিকার আছে নিজ দেশের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর। যুক্তরাষ্ট্র নিজে প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। ২০১৫ সালেও মিনিটম্যান থ্রি নামে এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা পাঁচবার চালিয়েছে। কিন্তু মার্কিন নীতি বরাবরই যেহেতু উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে, কাজেই এ সংকটের পেছনে উদ্দেশ্যমূলক হস্তক্ষেপকেও মনে করা যায়।
উত্তর কোরিয়া নিয়ে অনেক কথাই প্রচলিত আছে, বিশেষ করে তার সামরিক প্রস্তুতি সম্পর্কে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া নিয়ে বেশির ভাগ গোয়েন্দা তথ্যই আন্দাজের ওপর ভর করে। দেশটির কোথায় কী ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার আছে, তার কোনো সঠিক তথ্য মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে নেই। ফলে আমেরিকার পক্ষে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ঠেকানোর উপায় কোনো ঘোষণা ছাড়া পারমাণবিক বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ করা এবং উত্তর কোরিয়া নামক দেশটি দখল করে নেওয়া।
প্রশ্ন হলো, সে পথেই কি এগোচ্ছে আমেরিকা? আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় অঞ্চলে গত কয়েক দশকের অস্ত্রের খেলার পরও কি নতুন করে আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র খুলবে যুক্তরাষ্ট্র? একেকটি দেশ ও অঞ্চল বিধ্বস্ত হয়েছে, চিরদিনের জন্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আবার কোনো যুদ্ধেই পুরোপুরি জিততে পারেনি দেশটি।
আমি মনে করি, বর্তমান সংকটে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের বাইরে সমাধান খুঁজতে হবে। পারমাণবিক অস্ত্র বন্ধে জাতিসংঘের আহ্বানে গত বছর সাড়া দিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। তাই বলা যায়, দেশটির সঙ্গে আলোচনা সম্ভব। সামরিক মহড়া বা উসকানিতে কোনো সমাধান নেই। আলোচনাই পারে উত্তর কোরিয়াকে নিবৃত্ত করতে, পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি থেকে সরে আসতে। কাজেই হুমকি-ধমকি কিংবা যুদ্ধ নয়, আলোচনা মধ্য দিয়ে বিশ্বশান্তি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।