শিক্ষা
অনিয়ম-দলবাজি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা চাই
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আরো সরলভাবে বললে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী তবে দখলদারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো? গ্রামীণ জীবনের চর দখলের ঘটনা, দখলে অংশ নেওয়া মানুষের হতাহত হওয়ার কাহিনী আমরা বিস্তারিত সংবাদপত্রের পাতায় পড়েছি। সমকালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন এখন সেই দখল-বেদখল কিংবা পাল্টা দখলের বহুরৈখিক স্থানে পরিণত হয়েছে। আগের দিনে শুধু জেনেছি, বিবদমান ছাত্রসংগঠনগুলো হল দখলের লড়াইয়ে নেমে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পত্রিকার পাতায় তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয়। এখন সময় বদলেছে, বদলেছে শিক্ষার্থীদের হানাহানির ধরণ, নানান বর্ণের শিক্ষকরাও ময়দানে আছেন এবং লড়ছেন নিত্যনতুন উপায়ে। ছাত্রসংগঠনগুলোও এখন আর আগের অবস্থায় নেই, হলদখলও নেই তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়ানক ঘটনা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাহীনতা এবং সার্বিক দৈন্যদশার কথা জোর গলায় জানান দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর দলবাজি-চাঁদাবাজির খবর আমরা আগেও জেনেছি কিন্তু সম্প্রতি ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারা নানান দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিজেদের বিশাল এক ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে। তারা কর্তৃপক্ষকে বলেছে, আমাদের পছন্দের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া না হলে বিশ্ববিদ্যালয় চলবে না। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় একপক্ষকে কাছে ডেকে মীমাংসা করতে গিয়ে আরো বেশি বিপাকে পড়েছেন, বিরাগভাজন হয়েছেন অন্য পক্ষের।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষত দীর্ঘদিনের, সেখানে উপাচার্যকে অপসারণের আন্দোলনে শিক্ষকরা দীর্ঘ সময় ব্যয় করছেন। যে শিক্ষকরা সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত তাঁরাই এখানে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি লম্বা সময় ছুটির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শিক্ষকদের একটি বড় দল সেখানে ফের আন্দোলনে ফিরেছেন। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষকের কাছে বিরাগভাজন হয়েছেন উপাচার্য, তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য নাকচযোগ্য কিছু নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে। মেধাহীন এবং তুলনামুলক কমযোগ্যদের দলীয় বিবেচনায় নিয়োগদান বর্তমান সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গেুলোতে এক মহামারী রোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষকদের পছন্দমমতো সময়ে পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ নিয়ে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থের সংঘাত দেখা দেওয়ায় অচলাবস্থা নেমে এসেছে। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয় অবরোধ করেছেন, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথাও পত্রিকার বরাতে আমরা জেনেছি।
কয়েকটি বিভাগের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের জের ধরে ছুটি এগিয়ে এনে দুই মাসেরও বেশি সময়ের অবকাশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়কে। নানান গুরুত্বপূর্ণ এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ছোট-বড় আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে অস্থিরতা এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আজকের এই দশার পেছনে আমাদের সমষ্টিগত দায় রয়েছে, এখানে যেমন কোনো একক ব্যক্তির দায় নেই, তেমনি সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। কখনোই একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দলীয় রাজনীতির মাপকাঠিতে মাপা উচিত নয়, সেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়াও হতে হয় স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা এককভাবে ভয়ানক ক্ষমতা চর্চা করেন, তারা কোনো নিয়ম কিংবা বিধির ধারেকাছেও নেই। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে সীমাহীন অনিয়ম, একাডেমিক ক্যালেন্ডার বাস্তবায়নের চেয়ে প্রদর্শনীমূলক কাজের প্রতি বেশি আকর্ষণ, দলীয় রাজনীতির নোংরা লেজুরবৃত্তি এখন তাদের প্রধান কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা এখনো নিশ্চলভাবে বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের দেশে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো মাৎস্যন্নায় কায়েম হয়ে যায়নি। এখনো আমাদের হাতে সময় রয়েছে এই করুণ দশার ইতি ঘটানোর। আমরা সবাই মিলে চাইলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, আমাদের প্রধান বিদ্যাপীঠগুলো হয়ে উঠবে পৃথিবীর সেরা শিক্ষালয়গুলোর অংশ।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়