আন্তর্জাতিক
ফ্রান্সে ঘৃণার পরাজয়
বিশ্বব্যাপী চরমপন্থার উত্থানে গণতন্ত্রকামী মানুষ যখন শঙ্কিত, তখন ফরাসি নির্বাচনে উদারপন্থীদের জয় আশাবাদের সৃষ্টি করেছে। সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার দেশ ফ্রান্স। ১৭৮৯ সালের গৌরবোজ্জ্বল ফরাসি বিপ্লবের কারণে ইতিহাসে স্থায়ী আসন পেয়েছে ফ্রান্স। স্থিতিশীলতার বদলে অস্থিতিশীলতার রেকর্ড রয়েছে ফরাসি জনগণের। এককালে দুর্দ- ফরাসি সাম্রাজ্যের ধারক ফ্রান্স। ব্রিটিশদের পর ফরাসিরাই গড়ে তুলেছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য। সে কারণে ফরাসি ভাষা এখনো পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ভাষা। ফ্রান্সকে বলা হয় ‘ইউরোপের সাংস্কৃতির পাদপীঠ’। সাম্প্রতিককালে ফ্রান্সে বারবার সন্ত্রাসী ঘটনা, অভিবাসী সমস্যা এবং অর্থনৈতিক অবক্ষয় দেশটিকে চরমপন্থী রাজনীতির দিকে ধাবিত করছিল। পৃথিবীব্যাপী একধরনের রক্ষণশীল রাজনীতির আবির্ভাব ফ্রান্সের আকাশকেও মেঘাচ্ছন্ন করে ফেলছিল। তাই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আশা ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল সর্বত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া, সাম্প্রদায়িকতার ঘনঘটা এবং বেশির ভাগ দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ফ্রান্সে চরমপন্থার বিজয় অনিবার্য করে তুলবে এ রকম আশঙ্কা ছিল- অনেক বিশ্লেষকের। অবশেষে ফ্রান্সে আবার সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সপক্ষের বিজয়ে আশান্বিত হয়েছে আলোকিত পৃথিবী।
মধ্যপন্থার বিজয়
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ফ্রান্সে এত উত্তাপ ছড়ায়নি আর কোনো নির্বাচন। বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নির্বাচনটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায়। এই প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিয়ে সরব হয়েছে বিশ্ব। তাবৎ শান্তিকামী মানুষ আশা করেছে মধ্যপন্থার বিজয়। মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ এবং কট্টরপন্থী মারিন লা পেনের মধ্যে যখন ভোটযুদ্ধ চলছিল তখন উগ্রবাদী শক্তিগুলো লাপেনকে মদদ দিয়ে যাচ্ছিল। নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনার মতো সত্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উভয়ই এক রকম জোড়েসোরেই লা পেনের পক্ষ নিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় রুশ পক্ষের হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ইমানুয়েল ম্যাকরোঁর প্রচারতথ্য চুরির অভিযোগও ঘটে। অবশেষে ফরাসি জনগণ শান্তি ও স্থিতিশিলতার পক্ষে রায় দেয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর দিন প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের কাছে ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা হাতে উল্লাস প্রকাশ করে বিজয়ী ম্যাকরোঁর লোকজন। তাদের অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘ফ্রান্স বলছে : আর ঘৃণা নয়’। উল্লেখ্য, লা পেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা ছড়িয়েছিলেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ম্যাকরোঁর পরিচয়
ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ গতানুগতিক রাজনীতিবিদ নন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদঁর ক্যাবিনেটে তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ৩৯ বছর বয়সী সাবেক বিনিয়োগ ব্যাংকার ম্যাকরোঁ আগে কোনো নির্বাচনে কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় ম্যাকরোঁর কোনো অবস্থান থাকার কথা নয়। কিন্তু, ব্যক্তিগত সততা, অভিজ্ঞতা এবং নতুন আশার বাণী জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। লোকজন প্রথাগত পুরোনো রাজনীতিবিদদের বদলে নতুন ম্যাকরোঁকে স্বাগত জানায়। তাঁর জয় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদে দশকের পর দশক ধরে প্রধান দুই দলের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছে। এই নির্বাচনে দেশপ্রেম ও বিশ্বায়নপন্থীদের জয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট ‘নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের আহ্বান জানিয়েছেন।’
ইউরোপের স্বস্তি
ম্যাকরোঁর সহজ জয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। লা পেনের কট্টরনীতি ও যুক্তরাজ্যের বেক্সিটের আদলে গণভোটের মাধ্যমে ইইউ ছাড়ার পরিকল্পনায় ইউরোপের নেতারা শঙ্কিত ছিলেন। লা পেন হুমকি দিয়েছিল, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ইউরো মুদ্রার ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থেকে ফ্রান্সকে প্রত্যাহার করবেন। অন্যদিকে ম্যাকরোঁ ইইউর শক্তি ও সংহতির পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যঁ-ক্লদ ইয়ুঙ্কার বলেছেন, ফ্রান্সে কটি ইউরোপীয় ভবিষ্যৎ বেছে নিয়েছে বলে তিনি খুশি। বিবিসি টেলিভিশন তাদের বিশ্লেষণে বলেছে, ব্রিটেনের পক্ষে ইইউ ছাড়া যত সহজ, ফ্রান্সের পক্ষে ততটা সহজ নয়। কারণ, ফ্রান্স মূল ইউরোপ ভূখণ্ডে অবস্থিত এবং ইউরোপীয় রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল এই বলে ম্যাকরোঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন যে, তিনি লাখো ফরাসি জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা গতানুগতিক ভাষায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। লা পেন প্রেসিডেন্ট হলে তিনি হয়তো উষ্ণ বার্তা পাঠাতেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য একটু ভিন্ন ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস কট্টরপন্থার হুমকি বৃদ্ধির এই সময়ে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার পক্ষে ম্যাকরোঁর বিজয় গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাকরোঁর চ্যালেঞ্জ
সংকটময় ফ্রান্সের নেতৃত্ব দেওয়া ম্যাকরোঁর জন্য সহজ হবে না। তিনি তাঁর বিজয়ী ভাষণে ফ্রান্সে ‘তারুণ্যদীপ্ত রাজনৈতিক বিপ্লব’ ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি চান দেশকে এক সুতোয় গাঁথার ক্ষমতা আছে এমন এক শক্তিশালী নেতৃত্বের ঐতিহ্যে ফিরে যেতে। কিন্তু তাঁর জন্য এ কাজগুলো সহজ হবে না। ম্যাকরোঁ এমন একসময় দেশের দায়িত্ব নিচ্ছেন, যখন ফ্রান্স দশকের পর দশক ধরে বিপুল বেকারত্বের ভারে ন্যুব্জ্, স্থবির অর্থনীতি নিয়ে অধৈর্য এবং নিয়মিত সন্ত্রাসী হামলার হুমকিতে তটস্থ। এ ধরনের মন্তব্য করে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান আরো বলে যে, দেশটিতে ধনী ও গরিবের মধ্যে, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে তা দূরীকরণ সহজ হবে না। তা ছাড়া লোপেন ঘৃণা ছড়িয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন, সে বিষবৃক্ষ উৎপাটনে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। ম্যাকরোঁর ব্যবসাবান্ধব আর্থিক প্রকল্প এবং বিশ্বায়ন সহায়তা যদি কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে না আনে তা হলে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে। তার ফলে উগ্রবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুযোগ পাবে। তিনি অভিবাসীদের কাজে লাগানোর স্বার্থে কঠোর শ্রম আইন বদলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফরাসি জনগণ এ বিষয়টিও ভালো চোখে দেখবে না। তাই গার্ডিয়ান মনে করে, ‘এ ক্ষেত্রে নতুন প্রেসিডেন্টকে নিজস্ব বলয়ের বাইরে পৌঁছানোর সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে।’
পার্লামেন্ট নির্বাচন
ম্যাকরোঁর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন। আগেই বলা হয়েছে ম্যাকরোঁ একজন অপেশাদার রাজনীতিবিদ। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা থেকে ভিন্নতর তাঁর অবস্থান। তাঁর নতুন দলের নাম অঁ মার্শ-এর অর্থ এগিয়ে চলা। পার্লমেন্টের নির্বাচনে চমক দেখানো তাঁর জন্য কঠিন। সে ক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে, তা হবে তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফরাসি জনগণ যদি তাঁর দলের প্রতি চমক দেখায় তা হলে, তিনি উৎরে যাবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তাঁকে নতুন জোট গড়ার জন্য দরকষাকষি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ সীমিত হয়ে আসবে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ দেশটিতে সৃষ্টি হওয়া বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেছেন। তিনি ৬৬.১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী কট্টর ডানপন্থী মারিন লো পেনকে ৩৩.৯ শতাংশ ভোটে পরাজিত করেছেন। তাঁর প্রতি আরোপিত বিপুল সমর্থন এই বিশ্বাস দেয় যে তিনি বিভেদ দূর করে ঐক্যবদ্ধ ফ্রান্স গড়তে পারবেন। বিজয়ের পর সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ম্যাকরোঁ বলেন, তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন লো পেনের সমর্থকরা যেন কট্টরপন্থী কাউকে ভোট দেওয়ার যৌক্তিক কারণ খুঁজে না পায়।
উল্লেখ্য, ম্যাকরোঁর জয় মিশ্র প্রকৃতির ফ্রন্সে শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য আনয়নে গুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার অবসান। এই জয়ের মধ্য দিয়ে নেপোলিয়ন বোনাপোর্টের পর ম্যাকরোঁ ফ্রান্সে সবচেয়ে কম বয়সী নেতা হয়ে ইতিহাস গড়লেন। তাঁর বিজয়ে নেপোলিয়নের ধাঁচ আছে। তবে কত ধার আছে তা ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে। ফরাসি জনগণ একসময় সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণী নিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ছিল ১৭৮৯ সালে। এ সময় ওই বিপ্লব পৃথিবীকে আন্দোলিত করেছিল। সেখানে আজও যে মানবতার বাণী নিঃশেষ হয়ে যায়নি কট্টরপন্থীদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তা আবার প্রমাণিত হলো।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়