মোবাইল ফোন রিসাইক্লিং : সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/06/09/photo-1497014588.jpg)
১৯৯০-এর দশকে, এমনকি ২০০০ সালের প্রথম ভাগে কারো বাসায় একটি ল্যান্ডফোন থাকাটা বেশ গর্বের একটা ব্যাপার ছিল। আর হাতে একটি মোবাইল ফোন থাকলে তো কোনো কথাই নেই। সময়টা এমনই ছিল যে বেশির ভাগ মানুষেরই ফোন কেনা বা সংযোগ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। দেখা যেত, শুধু শহরাঞ্চলে বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে ল্যান্ডফোন ব্যবহার করছে একটি চারতলা বাড়ির প্রতিটি পরিবার।
গত দেড় দশকে এই দৃশ্যপটের দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। ব্যবহারের ফোন ঘরের কোণা থেকে চলে এসেছে একেবারে হাতের মুঠোয়। ফোন এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয়তা। আর ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার-উপযোগিতা শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব যেন মানুষের হাতের মুঠোয়। আমাদের যোগাযোগের ধরনে, জীবনযাপনে, ব্যবসায়, এমনকি বিনোদনেও মোবাইল ফোন নামের ওই ছোট ডিভাইসগুলো যেন এক বিশাল বিপ্লব নিয়ে এসেছে।
ডিজিটাল বিপ্লবের এই যুগে আমরা আমাদের প্রয়োজনানুসারে যখন ইচ্ছে তখন যে কারো সঙ্গে কথাই বলতে পারি। শুধু তাই নয়, তাদের একই সঙ্গে সরাসরিও দেখতে পারি। এই ব্যাপারটি কোনো একসময় গল্পের বই, সিনেমা কিংবা টিভি সিরিজের বিজ্ঞানকল্পের ধারণা হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আমাদের বাসার দরজায় চলে আসে মাসের বাজার, এক ক্লিকেই তাৎক্ষণিকভাবে টাকা স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে আর দিনের যেকোনো সময় যেকোনো জায়গাতেই পেয়ে যাচ্ছি যানবাহন। কোনো প্রিয়জনের হয়তো জরুরি রক্ত প্রয়োজন। সামাজিক মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কয়েকশো রক্তদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলা যাবে। ব্যাংকের বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দেওয়া ভালোভাবেই কয়েকটি ক্লিকে পরিশোধ করার ব্যাপারটা তো শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। এখন পর্যন্ত আমাদের জীবনযাত্রায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, এগুলো তার ছোট কিছু উদাহরণ। আশার কথা হচ্ছে, অভিনবত্বের এই কেবল শুরু। প্রতিনিয়তই আমাদের জীবনে প্রযুক্তির নতুন ধারা যোগ হচ্ছে। আর এসব প্রযুক্তি আমরা আমাদের হাতের মুঠোয় বাসায় বসে উপভোগ করতে পারছি।
সামগ্রিকভাবে প্রযুক্তি যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাজারে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মোবাইল ফোনে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। এ জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মানুষ পুরোনো ফোন ফেলে নতুন মডেলটি কেনার জন্য ছুটছে। আজ মোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও চলছে প্রতিযোগিতা। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময়ই চেষ্টা করছে নতুন ফিচার বা ডিজাইনের ফোন নিয়ে আসার। এর ফলে কিছুদিন পরপরই বাজারে নতুন মডেলের ফোন আসছে, আর গ্রাহকরা তা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। নতুন উদ্ভাবনের প্রতি মানুষের এই আকর্ষণ খুবই স্বাভাবিক।
তবে এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, পুরোনো ফোনগুলোর কী হয় বা হবে?
একজন ব্যবহারকারী সাধারণত একটি মোবাইল ফোন গড়ে ২৪ মাসের বেশি ব্যবহার করে না। ফোন পুরোনো হয়ে গেলে তারা সাধারণত আরেকটি মডেলের ফোন কিনে থাকে। নতুন ফোনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা নতুন অভিনব ফিচারের কারণে গ্রাহক মডেল পরিবর্তনে আকৃষ্ট হয়। নতুন ফোন কেনার জন্য অনেকেই তাদের পুরোনো ফোনটি বিক্রি করে ফেলে। প্রথম ক্রেতার আর ব্যবহার না করার কারণে অথবা দ্বিতীয় ক্রেতার হাত বদল হয়ে এসব হ্যান্ডসেট একসময় ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যায়। তবে শহরাঞ্চলের ব্যবহারকারীরা তাদের পুরোনো ফোনটি বাসাতেই ফেলে রাখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা এই অব্যবহৃত ফোনের মোবাইলের কথা ভুলেও যায়।
একপর্যায়ে ঘর পরিষ্কার করার সময় যখন এই বাতিল ফোন খুঁজে পেলে অধিকাংশ সময় তার স্থান হয় বাসার গারবেজ বিনে। ওখান থেকে তা চলে যায় আবর্জনার ভাগাড়ে, যে জায়গাটি এমনিতেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর একটি জায়গা। আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে, আবর্জনার ভাগাড়ের অন্যান্য যে কোনো জিনিসের চেয়ে মোবাইল ফোনে বিদ্যমান বিভিন্ন উপাদান অনেক বেশি ক্ষতিকর।
মোবাইল ফোনের বৈদ্যুতিক সার্কিটগুলোতে থাকে পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বেরিলিয়ামসহ অগ্নিপ্রজ্বালক বিভিন্ন উপাদান। অসাবধানে রাখা আবর্জনার ভাগাড় থেকে সহজেই এই বিষাক্ত উপাদানগুলো মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। একটি মোবাইল ফোনের ব্যাটারিতে যে পরিমাণ ক্যাডমিয়াম থাকে তা দিয়ে সহজেই ছয় লাখ লিটার পানি বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে। ফোনের সার্কিট তৈরিতে ব্যবহার্য অগ্নিপ্রজ্বালক, সিসা ও বেরিলিয়াম হতে পারে বিবিধ রোগবালাই যেমন ক্যানসার, যকৃতের ক্ষতি এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির কারণ। মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে ও সার্কিট বোর্ডে ব্যবহৃত পারদ খোলা অবস্থায় মস্তিষ্ক এবং বৃক্কের জন্য ক্ষতিকারক। যে মাত্র এক চামচ পারদ অনায়াসে ২০ একর আকারের একটি জলাভূমিকে বিষাক্ত করে তুলতে পারে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মানুষের হাতে ১০ কোটিরও বেশি সচল মোবাইল ফোনসেট রয়েছে। আর বিগত ২০ বছরে অচল ফোনসেটের সংখ্যা কত তা অনুমান করাও কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে গড়ে প্রতিবছর তিন কোটিরও বেশি মোবাইল আমদানি হচ্ছে। তার মানে হলো, নতুন করে তিন কোটিরও বেশি মোবাইল সেট স্বাস্থ্য ও পরিবেশে ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি করছে। আমরা হয়তো এ বিষয়টি এখন একদমই ভাবছি না । কিন্তু সত্যি হলো আমরা এরই মধ্যে একটি বিশাল ই-বর্জ্যের ভাগাড় তৈরি করে ফেলেছি। বাহ্যিকভাবে গন্ধ না ছড়ালেও এই ভাগাড়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর।
যেহেতু বৈশ্বিকভাবে মোবাইল ফোনের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফোনসেটের ই-বর্জ্য থেকে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণও একইভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে আমরা এক সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে এই বিপর্যয়ের বিষয়টাকে আমরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। আমাদের পরিবেশের দায়িত্ব আমাদেরই সবার আগে নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এখানে অবদান রাথতে পারি।
এই ব্যাপারে শুধু আলোচনা বা বাক্য ব্যয় না করে আমাদের উচিত সরাসরি কাজে নেমে পড়া। আর এর অন্যতম পদক্ষেপ হবে আমাদের পুরোনো ফোনগুলো যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং বা পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা করা যাতে করে মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে পরিবেশদূষণ থেকে বিরত রাখা যায়।
একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণফোন পুরোনো মোবাইল ফোন সংগ্রহ এবং সেগুলোকে পরিবেশবান্ধব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং-এর একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যে কেউ পার্শ্ববর্তী গ্রামীণফোন সেন্টারে গিয়ে নিজের পুরোনো বা ব্যবহার-অযোগ্য ফোনটি বৈজ্ঞানিকভাবে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করতে পারেন। এখানে মনে রাখতে হবে এসব ফোনগুলো এরই মধ্যে বর্জ্যে পরিণত হয়েছে এবং এটি সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে আপনি আপনার পরিবেশকেই রক্ষা করছেন।
গ্রামীণফোনের এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এ দায়িত্ব সবার। সবাইকে তাদের এই নাগরিক দায়িত্বটি নিতে হবে। আর এই দায়িত্ব শুধুমাত্র আমাদের পরিবার বা আমাদের দেশের প্রতি নয়, আমাদের দায়িত্ব সব মানুষের প্রতি এবং বিশ্বজুড়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি। একটি প্রতিজ্ঞা আমরা এখনই করতে পারি – মোবাইল ফোন থেকে উৎসরিত ই-বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনায় এখন থেকে আমরা সবাই সচেতন হবে এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজে এবং অপরকে উৎসাহিত করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হোক ই-বর্জ্যমুক্ত।
লেখক : হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, গ্রামীণফোন লিমিটেড