বক্তব্য
থিয়েটারে স্টান্টবাজির অবসান হোক
গত ২০ জুলাই শিল্পকলা একাডেমির একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন নাট্যকর্মী আমার নামে বিভিন্ন বক্তব্য, কুৎসা রটনা ও মিথ্যাচার করে বেড়াচ্ছে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের সাথে ডিরেক্টরস গিল্ডের অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের বিষয়ে আমার সভা ছিল। শিল্পকলা একাডেমির মূল গেট দিয়ে ঢোকার সময় পুলিশ এবং র্যাব কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হই এবং বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ করি। আমি গাড়ি থেকে নেমে যাই এবং পাশাপাশি আরেকটি গাড়ি থেকে অভিনেতা জাহিদ হাসান নেমে আসেন। আমাকে দেখে একাডেমির একজন নিরাপত্তা অফিসার দৌড়ে আসেন। তিনি অভিযোগের সুরে জানান যে, ‘আরণ্যকের ছেলেরা গোলমাল করছে, সেজন্য সব গেট বন্ধ করা হয়েছে।’ তখন আমি বুঝতে পারি এ আসলে ‘তীরন্দাজ’ নাট্যদলের নাট্যকর্মীদের ব্যাপার।
ওই নিরাপত্তা অফিসার দীপক সুমন ও মিতালী দাশকে ‘আরণ্যক’-এর কর্মী হিসেবেই চেনেন। চেনার সঙ্গত কারণও আছে, কারণ তারা ‘আরণ্যক নাট্যদল’-এর প্রাক্তন বহিষ্কৃত সদস্য। এখন পর্যন্ত ‘তীরন্দাজ’-এর স্বাক্ষর তাদের গায়ে লাগেনি- এটা লাগতে সময় লাগে। যাই হোক, আমি মহাপরিচালকের অফিসের দিকে এগিয়ে যাই এবং দেখতে পাই দীপক সুমন মহাপরিচালকের অফিসের লাউঞ্জে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। আমি বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করি- কারণ দীপক সুমন টেলিফোনে আমাকে জানিয়েছিল-শিল্পকলা একাডেমির নাট্যমঞ্চে আনু মুহাম্মদের নির্ধারিত ‘বাহাস’ করতে দেবে না। প্রত্যুত্তরে দীপক সুমন একাডেমির সচিবকে জানিয়ে দেয়- বাহাস আয়োজন সে করবেই, পারলে যেন শিল্পকলা ‘ঠ্যাকায়’। তারপর ‘তীরন্দাজ’ ও ‘শিল্পকলা একাডেমি’ মধ্যে যথেষ্ট বাগবিতণ্ডা হয়ে গেছে।
আমার সামনাসামনি হতেই দীপক সুমন অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল- ‘আরণ্যক শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে, জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে দিয়ে বক্তৃতা দেওয়ায়... অথচ আমরা থিয়েটারের মঞ্চে বাহাসের আয়োজন করলেই বাধা আসবে কেন?’’- ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যুত্তরে আমি বলি ‘জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে দিয়ে নাটকের আগে কখনো বক্তৃতা দেওয়া হয়নি। কোনো মঞ্চেই নয়। সেটা আমরা করি শহীদ মিনারে মে দিবসে।
নাট্যমঞ্চ বাহাসের জায়গা নয়। এও বলি সুন্দরবন নিয়ে আনু মুহাম্মদ কথা বলবেন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই বলবেন, কিন্তু তার জন্য আলাদা জায়গা নির্ধারণ করা দরকার। আমি এও বলি তুমি সুন্দরবন নিয়ে নাটক কর। সেই নাটক যার বিরুদ্ধেই যাক না কেনো, যদি কোনো কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে আমি তোমার পাশে দাঁড়াব। এই বাদানুবাদের পর আমি মহাপরিচালকের কক্ষে যাই এবং নাটক বন্ধের কারণ জিজ্ঞাসা করি। মহাপরিচালক আমাকে বলেন আমরা বাহাস বন্ধ করতে বলেছি এবং সরাসরি টেলিকাস্ট করার জন্য যে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিল সেগুলো সরিয়ে নিতে বলেছি, কিন্তু নাটক বন্ধ করতে বলিনি। কিন্তু কোনো কিছুতেই যখন তারা মানছিল না বরং আমাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিল তখন আমরা হল বরাদ্দ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি। আমি মহাপরিচালককে অনুরোধ করি আপনি ওদের সাথে কথা বলুন। পরে মহাপরিচালক লাউঞ্জে লোক পাঠান কিন্তু ততক্ষণে তারা চলে গেছে এবং বাইরে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে। মহাপরিচালক তার সিসি ক্যামেরায় সেটি দেখালেন।
এদিকে আমাদের ডিরেক্টরস গিল্ডের আশু নির্বাচনের দিনের নিরাপত্তাসভা প্রায় ভণ্ডুল হওয়ার দশা। কারণ আমরা সব সময়ই মনে করি জঙ্গি এবং মৌলবাদীদের কাছে শিল্পকলা একটি টার্গেট। কাজেই আমাদের সামনেই মহাপরিচালকের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর লোকজন তাদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা চায়। আমি দৃঢ়ভাবে বলি কোনো রকমের বল প্রয়োগ করে যেন তাদের বের করা না হয়। একটি জিডি করার ব্যাপারেও চাপ আসতে থাকে। আমি সেটাও নিষেধ করি। কাজেই নাটক বা বাহাস বন্ধের ব্যাপারে শিল্পকলা একাডেমির সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার সাথে এর আগে কর্তৃপক্ষের কোনো কথাই হয়নি এই হচ্ছে মূল ঘটনা। এই সঙ্গে বলতে চাই হল বরাদ্দ ও বাতিলের আমি কে? আমিও সব নাট্যদলের মতোই হল বরাদ্দ প্রত্যাশী।
আমরা জেনে শুনেই রাজনীতির পথ বেছে নেইনি। বেছে নিয়েছি শিল্পের কঠিন পথ। নাট্যমঞ্চে আমরা অভিনয় করি। শিল্পের মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রকাশ করি। এই জায়গাটায় বক্তৃতা দিয়ে আমরা কারো বিরক্তি উৎপাদন করব না। বিভিন্ন উৎসব উদ্বোধনকালে দেখেছি নাট্যমঞ্চে উদ্বোধনী বক্তৃতাটি পর্যন্ত দর্শক শুনতে চান না। তাঁরা আসেন নাটক দেখতে- দর্শনীর বিনিময়ে। তাই আমরা কখনো নাটকের আগে এমন কোনো ধরনের বক্তৃতা দেওয়ার পক্ষে নই যাতে দর্শক বিরক্ত হয়। আবারও বলছি সুন্দরবন ইস্যুতে আনু মুহাম্মদ কথা বলবেন সেটা খুবই যথার্থ। কিন্তু নাটকের আগে মাত্র একঘণ্টার জন্য কেন? তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন। কিন্তু সেটা বলার আসল মঞ্চ হওয়া উচিত সেমিনার কক্ষ বা শহীদ মিনার বা অন্য যেকোনো জায়গায়। এর আগেও তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সেমিনার রুমে বা অন্যত্র বক্তৃতা দিয়েছেন। তখন তো তিনি বাধার মুখে পড়েননি। তাহলে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে ডেকে এনে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করা কি ঠিক হলো? এর দায় কি ‘তীরন্দাজ’ নেবে?
সব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে আমার কতগুলো প্রশ্ন জেগেছে-
ক. নাট্যমঞ্চ কি বাহাস-বক্তৃতার জায়গা? আজকে যদি শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চকে বাহাসের জন্য ব্যবহার করা হয় তাহলে কালকেই কোনো একটি রাজনৈতিক দল যদি এই সুযোগ নিতে চায় যে তারাও বাহাস করবে সেটা কি আমরা বন্ধ করতে পারব? মহানগর নাট্যমঞ্চে যখন এই প্রশ্রয়টি রাজনৈতিক দল পেল সেখানে আর নাটক করার কোনো পরিবেশ থাকল? নাটক সেখান থেকে বিতাড়িত হলো।
খ. দীপক সুমন আমার একুশে পদক প্রাপ্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার মতে আমি পদক পেয়ে সরকারি দলের লোক হয়ে গেছি। কেন? আমি কি একুশে পদক প্রাপ্তির পর সরকারি দলে যোগ দিয়েছি না সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা নিয়েছি? না, এমন কিছু আমার দ্বারা হয়নি। বরং সব সময়ের মতো আমার কণ্ঠস্বর ও লেখা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরো সোচ্চার রয়েছে।
গ. দীপক সুমন, মিতালী দাশ, সামিনা লুৎফা নিত্রা ভালো করেই জানেন আজ থেকে ১৮ বছর আগে ‘সুন্দরী’ নামে সুন্দরবনের ওপর ২৬ পর্বের একটি নাটক নির্মাণ করেছিলাম যার অনেক বক্তব্য সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। বর্তমান সরকারই তখন ক্ষমতায় ছিল। যার কারণে নাটকটি বিটিভিতে প্রচারের সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। ফলে সেটি বেসরকারি চ্যানেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নাটকটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল, কারণ সুন্দরবন ধ্বংসের ব্যাপারে এই নাটকে অনেক বক্তব্য ছিল। আগ্রহীরা ইচ্ছে করলে ইউটিউবে নাটকের শেষ পর্বটি দেখে নিতে পারেন। সেখানে কাঠগড়ায় আমার একটি জবানবন্দিতে সুন্দরবন ধ্বংস হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল কতটা বিপর্যস্ত হবে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
আজকে দেশের পরিবেশ আন্দোলন অনেক গতিশীল হয়েছে। সবাই জানে আমি কীভাবে খাসিয়াদের, গারোদের, সাঁওতালদের বনভূমি রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছি। তাদের নিয়ে নাটকও করেছি। দুঃখজনকভাবে সত্য সেই নাটকে এই তথাকথিত Activist-দের অনেকেই অভিনয় করেছে। দেশভাগ ও সাঁওতালদের ভূমিচ্যুত হওয়া নিয়ে আমি নাটক করেছি। আগামী ২৫ জুলাই ও ৩ অগাস্ট শিল্পকলা একাডেমির দুটি হলে নাটক-দুটি অভিনীত হবে। সেখানে আপনাদেরও আমন্ত্রণ রইল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাঁওতাল, মান্দি ও খাসিয়াদের জায়গায় ইকো পার্ক করার বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমি নেতৃত্বও দিয়েছি। তাহলে কোন বিবেচনায় আমি সুন্দরবন রক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়াব? সুন্দরবন রক্ষার বিষয়টি আজ আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আন্দোলনে আমাদের সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু আজকে Facebook-এ কী দাঁড়াচ্ছে? কোথায় সুন্দরবন, কোথায় আন্দোলন? সবকিছুর টার্গেট মামুনুর রশীদ। এভাবেই হঠকারীরা আন্দোলনে ঢুকে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি নাটক না করে স্ট্যান্টবাজী করেই বিখ্যাত হওয়ার অপচেষ্টা মাত্র।
ঘ. আমি বলে থাকি আমি শিল্পী নই। আমি প্রচারক। কিন্তু আমার প্রচার মাধ্যম হচ্ছে নাটক। আমার সৌভাগ্য আমার নাট্যকর্ম কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। নাটকের মাধ্যমে বিপুল দর্শকের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছি।
ঙ. যে কজন আমার চরিত্র হননের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কেউ কেউ আমাকে গুরু মানবেন না জেনে আমি আনন্দিত। আমি কারো কারো গুরুগৃহ ত্যাগ করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমি কারো গুরু নই, শিষ্যও নই। একটি শিশুর কাছ থেকেও আমি শিখি।
চ. আমার শেষ একটি প্রশ্ন ‘তীরন্দাজ’ কর্তৃপক্ষের কাছে তারা কোন যুক্তিতে একটি ব্যক্তিগত কথোপকথন বিনা অনুমতিতে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং করবে এবং সামাজিক প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করবে? তাও আবার সম্পূর্ণ অংশটি নয়, খণ্ডিত অংশ?
পৃথিবীতে আজ দুঃসময়, সুন্দরবনের দুঃসময়, নাটকের দুঃসময়। আসুন আমরা সকল দুঃসময়ের বিরুদ্ধে শিল্পের লড়াইটা চালিয়ে যাই।
এই প্রসঙ্গে এটাই আমার প্রথম ও শেষ বক্তব্য।
লেখক : নাট্যকার