সুলতানা কামালের আদি ঠিকানা
সুলতানা কামাল একটি প্রতীকী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তিনি কেবল মানবাধিকার নিয়েই কাজ করছেন তা নয়, তাঁর কণ্ঠস্বর আজকের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে প্রতিবাদের ভাষা রাজনৈতিক দলভিত্তিক হয়ে থাকে। কিন্তু সুলতানা কামাল দলীয় রাজনীতি করেন না। তিনি হচ্ছেন এ দেশের বিবেকবান মুক্তচিন্তার যে স্রোতধারা, তার অংশ।
এই স্রোতধারা বুঝতে হলে বাংলাদেশ গঠনের ইতিহাসে যাওয়া প্রয়োজন। সেই গঠন ছিল ১৯৪৭-এর পরের সময়কাল, যখন জনগোষ্ঠী পরিণত হলো একটি সক্রিয় সমাজগোষ্ঠীতে এবং সেই সমাজগোষ্ঠী রূপান্তরিত হলো রাজনৈতিক আন্দোলনে। এ কারণে আমরা ভাষা আন্দোলনের মূল বিষয়টি যদি ধরতে চাই, তাহলে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সবগুলোর সংমিশ্রণ বুঝতে হবে। এই সংমিশ্রণ আমাদের দেশের চরিত্র বহনকারী। যাঁরা মনে করেন, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের’, তাঁদেরই একজন সুলতানা কামাল। কিন্তু তাঁর অনুপ্রেরণার সূত্র কোনটি, সেটা বোঝার প্রয়োজন আছে। আমার মতে, সেই অনুসন্ধান নিয়ে সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাড়াগুলোতে, যেখানে তৈরি হয়েছিল এই মানসিকতা।
এই লেখা সেই কালের একটি বিবরণ। এটি নস্টালজিয়া নয়। এটি আয়নায় মুখ দেখা।
২.
আমি যে পাড়ায় বড় হয়েছি, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালও সেখানে বড় হয়েছেন। পাড়াটির নাম টিকাটুলী। এরই একটি অংশ তারাবাগে ছিল সুলতানা কামালদের বাড়ি। ওই পাড়ায় সবার জীবনযাত্রা ছিল প্রায় একই রকম। মূল্যবোধের কাঠামো ছিল অভিন্ন, যা পরেও চলতে থাকে। সম্ভবত পাড়ার সেই অভিন্ন মূল্যবোধের কাঠামোটি আমার ও আমার চেয়ে কিছু আগের প্রজন্মের মধ্যে এক অজানা শক্তি জুগিয়েছিল, সৃষ্টি করেছিল এক শক্তিশালী বন্ধন।
সুলতানা কামালের মা বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন পাড়ার কর্ত্রী। ১৯৫০-এর দশকের ওই দিনগুলোতে তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তাঁদের সঙ্গে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পরিবারের মতো। তিনি আমার নানির বান্ধবী হওয়ায় আমারও নানি। আমার ফকু মামা ছিলেন তাঁর ছেলে প্রখ্যাত সাংবাদিক শামীম মামার ঘনিষ্ঠ। তাঁদের অন্যান্য ভাই সাব্বির ও শোয়াইব ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, ভাইও। লুতু আপা ও টুলু আপা দুবোন ও পাড়াটি ছিল এ রকম আপা ও ভাইয়ে ভর্তি।
মানবিক যে চিত্র পাড়াটিকে অনন্য করেছিল তা হলো প্রতি বাড়িতেই একজন মামা, চাচা, আপা ইত্যাদি ছিলেন। আর সম্পর্কগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। সবাই ছিলেন একটি বিস্তৃত-বিশাল পরিবারের অংশ। ওই যুগে এটা ছিল খুবই সাধারণ, এর বেশি কিছু না এবং ‘এসব পরিবার’ ছিল পরস্পরের ঘনিষ্ঠ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবীদের অভিন্ন মূল্যবোধ তাদের একটি বন্ধনে বেঁধে রাখে। ১৯৪৭ সালের পর কলকাতা থেকে আসা অভিবাসীরাও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। দেশের পরবর্তী ইতিহাস বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরাই।
৩.
আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তখন সবাই একই রকম জীবনযাপন, খাবার খাওয়া ও আলোচনা করে দিন কাটাতে ভালোবাসত। তখনো আমার বোঝার মতো বয়স হয়নি। তবে দেখেছি, বাংলাদেশের প্রথম গুরুগম্ভীর সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ সম্পাদক কবি সিকান্দর আবু জাফর কাছেই একটি দোতলা বাড়িতে থাকতেন। তাঁর পাশের বাড়িতে থাকতেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর তাঁর ভাইকে নিয়ে। শিল্পীর ছোট্ট চালাটি নানা রকম পেইন্টিং, রং-তুলিতে ভর্তি ছিল; সেখান থেকে সুন্দর গন্ধ বের হতো। আসা-যাওয়ার পথে আমরা ওগুলো দেখতাম। আর ওগুলোই আমাদের বেড়ে ওঠার বয়সে রং, চিত্র, কাঠামো সম্পর্কে আবছা ধারণার জন্ম দিয়েছে। আমার স্মৃতিতে আজো যে ঘটনা সবচেয়ে জ্বলজ্বলে তা হলো, সিকান্দর আবু জাফর তাঁর এয়ারগান দিয়ে একটি কাককে গুলি করেছেন, কোত্থেকে হাজার হাজার কাক জড়ো হয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়। আমরা এই কাকের চিৎকার শুনতে ঘর থেকে নিচে নেমে এলাম... কতই না মজার ছিল দিনগুলো...।
৪.
চিত্রনায়ক বুলবুল ছিলেন আমাদের আরেক প্রতিবেশী, অবশ্যই আরেক মামা। আমি ছিলাম তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত। ৫০ বছর পরের কোনো এক দিন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। “দেখ ওকে দেখ। একদিন ওকে কাঁধে বসিয়ে গোটা টিকাটুলী ঘুরে বেরিয়েছি। ‘আমার সেই ঘটনা মনে আছে, কিন্তু তাকে মনে নেই। সত্যিই বলছি, তখন আমি লম্বায় ছয় ফুটের বেশি ছিলাম না। কিন্তু আমরা যখন কথা বলতাম, তখন বয়সের ব্যবধানটি যেন নিমেষে উধাও হয়ে যেত। তাঁর কণ্ঠে ছোটদের প্রতি মমতা ফুটে উঠত। সম্পর্ককে বুড়িয়ে দিতে পারে না সময়।’
আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে ছিল কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল। আমার মনে পড়ে টমটমে করে মেয়েরা স্কুলের গেটে এসে নামত। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পারিবারিক বন্ধুদের মেয়েরা এক রাত থেকেও যেত। এমন অনাবিল আনন্দের মধ্য দিয়ে আপুরা তাদের স্নেহ-মমতা উপহার দিত।
অথচ ১৯৫২ সালে এই স্কুলই প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সম্ভবত এই স্কুল থেকেই প্রতিবাদের কণ্ঠ উচ্চকিত হতে থাকে এবং পুলিশের গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালাতে সক্ষম হন অ্যাক্টিভিস্ট নাদিরা বেগম। আমার জন্মের কয়েক দিন পর আমার নানি রাস্তায় নেমে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আরো অনেক মা সেদিন রাস্তায় নেমে আসেন, আর প্রতিটি পাড়াই একেকটি প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই প্রতিরোধ কোনো দাবি আদায়ের জন্য ছিল না, ছিল সন্তানদের ওপর গুলি ছোড়ার প্রতিবাদে। এসব নারীর অনুপ্রেরণাতেই সেদিন আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে।
৫.
আজ সুলতানা আপা তাঁর মন্তব্যের জন্য হেফাজত ও অন্য ইসলামপন্থীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু টিকাটুলীর এক বাসিন্দা হিসেবে তাঁর ভূমিকাটি ছিল স্বাভাবিক। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে যার রূপান্তর ঘটা সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির, সেই অগ্রণী অংশেই তাঁর জন্ম হয়েছে। একটি ঘটনা বললে বিষয়টি আরো খোলাসা হবে।
একবার ঈদের জামাতে মাওলানা সাহেব বললেন যে হিন্দুদের জান্নাতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না তাদের বিশ্বাসের কারণে। এ রকম কথা শুনে আমার বেশ রাগ হলো। কারণ আমাদের পরিবারে কেউ কখনো এমন কথা বলেনি। তাই আমি মাকে জিজ্ঞেস করি। তাঁর উত্তর ছিল, ‘আল্লাহ শুধু ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ বিচার করবেন। ভালো মানুষ বেহেশতে যাবেন, খারাপ মানুষ দোজখে যাবে। আল্লাহ শুধু ভালো কাজ দেখবেন।’ এই সাধারণ ব্যাখ্যা আমাকে সারা জীবনের জন্য অসহিষ্ণুতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল।
এটা শুধু আমার মায়ের কথা ছিল না, এটা ছিল পাড়ার সবার মনের কথা। আমার মা যে কথা বলেছেন, বেগম সুফিয়া কামালও যা বিশ্বাস করতেন, সবই গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা। টিকাটুলীতে এত বেশি মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের কর্মীর জন্ম হওয়া কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।
তবে এটাও ঠিক, ১৯৭১ সালের সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়ারও মৃত্যু ঘটে। এখানকার মানুষগুলো যে মূল্যবোধ ধারণ করেছিল, তাও লোভ ও লালসার হাওয়ার তোড়ে হারিয়ে যায়। তবে তার মতো যারা তারাবাগে বেড়ে উঠেছে, যে মূল্যবোধের মধ্যে সে বড় হয়েছে, তা তাকে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তিনি যেমন সহিষ্ণু, তেমনি তিনি দেখিয়েছেন যে সহিষ্ণু কণ্ঠ হারিয়ে যাবে না। বালিকা বেলায় পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে এই কণ্ঠটিই তিনি শুনেছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।