ঈদ
মানুষের ‘দেশ’ কই থাকে?
ঈদে সবাই বাইরে যায়। সবাই ঘুরতে যায়। ঈদ যেন ঢাকায় না থাকার একটা উৎসব। যদিও অবস্থাটা পাল্টাচ্ছে। তবু বেশির ভাগ মানুষ পাগলের মতো হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে ‘দেশে’ যায়। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তাহলে অসহায় হয়ে বলে, ‘যেন দেশে ঈদ করতে পারি’। কেউ বলে, ‘এবার দেশে যেতে পারলাম না।’ ঈদ মনে করিয়ে দেয়, আর যাই হোক বেশির ভাগ মানুষের জন্য দেশ বলতে তার গ্রামকেই বোঝায়, এই রাজধানী নয়। হয়তো আমাদের রাষ্ট্র অনেকগুলো এ রকম দেশ মিলে একটা বাংলাদেশ। দেশ কই থাকে?
বাংলাদেশের গরিব মানুষরা সবচেয়ে কষ্ট করে ঈদে যায়। তাদের কাছে ঈদ মানে কদিনের জন্য স্বস্তি দেওয়া; আর বাড়ির মানুষের সঙ্গে বসে নিরাপদে আনন্দ। এই কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি।
তারপর যাওয়ার কষ্টের চেয়ে আরো কষ্ট করে ঢাকায় ফেরা। তারপরও প্রতিবছর তারা যায়। কারণ এই দেশ তাকে শান্তি না দিলেও দূরের ‘দেশটা’ তাকে একটু স্বস্তি দেয়।
দুদিনের জন্য হলেও নিরাপদ তন্দ্রা আসে। তাই যে আগ্রহের সঙ্গে মানুষ ঢাকা ছাড়ে, সেটা আমাদের নগরের নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য মানের শহর গড়ে তোলার সূচক।
ঢাকায় আরেক দল মানুষ থাকে। এরা মধ্যবিত্ত। এদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজার করা। এমনই বাজার-পাগল তারা, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতে যায় কেনাকাটা করতে। আর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এমনই বোকা, ভারতের চেয়ে বেশি দাম রেখে ঢাকায় বসে বিক্রি করে। তাদের ধারণা, বেশি দামটা তারা দেবে আমদানির জন্য। কিন্তু কলকাতায় যাত্রা করে ওখানকার সুশৃঙ্খল শহর ঘুরে বাজার করে ঢাকায় ফিরতে খরচ কম পড়ে এটা তাদের মাথায় ঢোকে না। এর ফলে এ বছর ব্যবসায়ীরা মার খেয়েছে। এই শপিং শ্রেণি এখন বেশ সবল। এরা দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের দান-খয়রাত করতে ইচ্ছা করে না, বাজার করতে ইচ্ছা করে।
আরেকটি শ্রেণি ঈদের সময় বিদেশে চলে যায়। এরা দেশে না থেকে ছুটির সুযোগে হলিডে করে। ব্যাংকক, শ্রীলঙ্কা, বিলেতে ভ্রমণে যায়। এদের অর্থবিত্ত আছে এবং ঢাকার ভয়াবহতা থেকে পালিয়ে কয়েক দিনের জন্য একটু স্বস্তি কিনে নেয়। এরা সংখ্যায় প্রতিবছর বাড়ছে।
এ ছাড়া আছে যারা নানা কারণে ঢাকা ছাড়ে না। একদল মানুষ আছে যাদের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ নেই, কখনই ছিল না। তাদের কাছে দেশ বলতে ঢাকাই বোঝায়। যত জঘন্য এই শহর হোক। তারা ট্রাফিক জ্যামমুক্ত শহরের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করে। সম্ভবত দুই রাকাত শোকরানার নামাজও হয়তো আদায় করে এ কারণে।
এরা এ সময়ে আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। দুই ঘণ্টার পথ ২০ মিনিটে পৌঁছে মনে হয়, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো ট্রাফিক জ্যামহীন ঈদ।’
ঈদের ভিড় ঠেলে কেউ কেউ দেশে যায় না। কেউ ছুটি পায় না, কেউ অসুস্থ ইত্যাদি। বস্তিবাসী কিছু গ্রামের মানুষও আজকাল দেশে যায় না। এসব মিলে ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা তৈরি হচ্ছে। যারা ঈদেও কোথাও যায় না।
এই যাওয়া ও আসা মানুষের মধ্যে নতুন সমাজতত্ত্ব তৈরি হচ্ছে। ভাঙাচোরা শ্রেণিগুলো আরো ভাঙছে। মধ্যবিত্ত ১০ অংশে বিভক্ত, প্রায় সবারই ভোগ-উপভোগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবন। গরিব মানুষ এখনো জান দিয়ে দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং জানটা দেয় তারাই। এবারের ঈদও ব্যতিক্রম নয়। আর বড়লোকরা ঈদের আনন্দ আর কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে। তারা এখন সবার মতোই ঢাকার অস্থায়ী বাসিন্দা। ঢাকা এখন অস্থায়ী মানুষের রাজধানী।
অস্থায়ী সমাজ, অস্থায়ী নৈতিকতা, অস্থায়ী ইনসাফ, অস্থায়ী দেশ...
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক