বিশ্বজিৎ হত্যা
‘খুনি’ বানাচ্ছে কারা?
৬ আগস্ট রোববার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগ একটি মামলায় নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ের আপিল আবেদনের শুনানি শেষে নতুন করে রায় দিয়েছেন। এই রায়ে দুজনকে ফাঁসি ও চারজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। রায়ে আদালত বলেন, ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে আসামিরা সংঘবদ্ধভাবে ভিকটিমকে হত্যা করেছে। তবে আদালত পর্যবেক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। রায়ের চেয়ে এই পর্যবেক্ষণের কথাটিই এখন বেশি প্রাসঙ্গিক। আদালত বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেন রাজনৈতিক দল দ্বারা ব্যবহৃত না হয়।’ তার মানে আদালত জানেন যে এই মামলায় শাস্তি পাওয়া আসামিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং আদালত বুঝতে পেরেছেন এই আসামিরা কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণেই খুনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছেন।
খেয়াল করবেন, আদালত বলেছেন ‘ব্যবহৃত’ যেন না হয়। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল দ্বারা ব্যবহৃত হন এবং ব্যবহৃত হয়েই খুনি হন, সে বিষয়টি আদালত পরিষ্কার হয়েছেন। আসামিরা যদি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে না জড়াতেন এবং ক্ষমতা চর্চায় প্রলুব্ধ না হতেন, তা হলে অপরাধ করতেন না। খুন করার সাহস পেতেন না। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয় এবং ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীরা প্রায়ই হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য কাজও করেন—এমন কথা নতুন নয়। অতীতে এ সত্য বহুবার উচ্চারণ করেছেন দেশের সুশীল সমাজ। এমনকি বলেছেন সেসব বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র-শিক্ষকরাও। বিভিন্ন সময়ে দাবি জানিয়েছেন ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসী ও খুনি বানানোর এই অপতৎপরতা বন্ধ করতে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার এসব অভিযোগ কানে তোলেনি।
এখন যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত পরোক্ষভাবে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা খুনি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং এসব খুনি নিজেরা যতটা খুনি, তার চেয়ে বেশি তারা খুনি হতে বাধ্য হয়েছে বা তাদের খুনি বানানো হয়েছে, তখন অস্বীকারকারীরা কী বলবেন, যাঁরা এসব খুনি বানানো ছাত্ররাজনীতি সমর্থন করে গেছেন কারণে কিংবা অকারণে? আমার মনে হয় না আদালতের পর্যবেক্ষণের কোনো জবাব তাঁদের কাছে আছে। কেননা, যে ঘটনায় আদালত এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সে ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বগুড়ার তুফান সরকারের ঘটনার পর থেকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে তা হলো ক্ষমতা বা ‘পাওয়ার পলিটিকস’ অপরাধকাণ্ডের জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। এটি আসলে অনেক দিন ধরে চর্চিত একটি সত্য। নতুন কিছু নয়। হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে আসা ‘ব্যবহৃত’ হওয়ার বিষয়টিও এই পাওয়ার পলিটিকসের সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি মানুষকে অন্ধ করে দেয়, ধরাকে সরা জ্ঞান করায় প্রলুব্ধ করে। তখন অপরাধ সংঘটন কোনো বিষয় হয় না তাদের কাছে। যে ঘটনায় আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা খুনি বলে প্রমাণিত হলেন, সেই ঘটনাও একইভাবে ক্ষমতা বা পেশিশক্তি ব্যবহারের একটি উদাহরণ।
এটা অনুমান করা কঠিন কিছু হবে না যে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎকে চাপাতির কোপে আর লোহার রডের আঘাতে যখন ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছিল, তখন আঘাতকারীদের কারো ভেতরেই এই বোধটুকু আসেনি যে তারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; দেশসেরা ছাত্রদের থেকে বাছাই করা শিক্ষার্থী, এভাবে মানুষ পিটিয়ে মারা তাদের শোভা পায় না; হোক সে অপরাধী, সন্ত্রাসী কিংবা তাদের ভাষায় পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী। এই বোধ আসেনি কারণ তারা মনে করেছিল, নানা কারণে তারা অনেক ক্ষমতাশালী। তাদের অনেক কিছু করার অধিকার আছে, এমনকি মানুষ খুনেরও। এতে তাদের কিছু হবে না। কেউ তাদের কিছু বলবে না। এই যে নিজেদের অনেক কিছু মনে করা, এটা তো আর এমনি এমনি হয়নি।
আমার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সর্বোচ্চ নম্বরধারী মেধাবী শিক্ষার্থী। তাঁর মুখে ইংরেজি বক্তৃতা শুনে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত। সেই মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছেন ‘খুনি’ হয়ে। হলের আলোচিত খোকন হত্যার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গুলি করে দুই পুলিশ সদস্যকে খুন করার। একইভাবে ‘খুনি’র তকমা লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয় তাঁর কিছু অনুগত ছোট ভাইকেও। যাঁরা সবাই স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ভালো ফল করে, যার যার এলাকার আশার প্রদীপ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের গ্রামের মানুষেরা স্বপ্ন দেখতেন এসব তরুণ একদিন অনেক বড় হবে, গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবে। কিন্তু যেখানে এই তরুণেরা বড় মানুষ হতে এসেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত তাকে খুনি বানিয়ে চার দেয়ালের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে!
প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের এভাবে মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে বিপথে চলে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী কেবল আমি বা আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীই নয়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর মহান শিক্ষকরাও। আমি দেখেছি এই মহান শিক্ষাগুরুরা এসব ‘শিক্ষার্থী থেকে খুনি’ বনে যাওয়া তরুণদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন, মিটিং-সমাবেশ করেছেন, চা-পানি পান করেন! শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জেতার জন্য, হলের প্রাধ্যক্ষ হওয়ার জন্য বা এমন আরো অনেক কিছুর জন্য শিক্ষাগুরুরা এদের সহায়তা নিয়েছেন। তাঁদের চোখের সামনেই এরা বিপথে গেছে। তাঁরা কিছুই বলেননি, কিছুই করেননি।
এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২-১৩ ছাত্র আদালতের রায়ে ‘খুনি’ প্রমাণিত হলো, এর জন্যই কি তাদের মা-বাবা কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন? তাদের মা-বাবা কি জানত বিশ্ববিদ্যালয় কেবল মানুষই বানায় না, খুনিও বানায়? সমস্ত জীবনের সঞ্চয় দিয়ে যে বাবা ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, আদালতের রায় শুনে তাঁর কি অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠেনি? তাঁর মনে তো এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, খাতা-কলমের জায়গায় তাঁর ছেলের হাতে অস্ত্র কারা তুলে দিল?
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই খুনিদের কয়েকজনের বাবা কৃষিকাজ করেন, কারো বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, কারো বা বাবাই নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এমন পরিবার থেকে উঠে আসা। অনেকে পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসার পাত্র। মা-বাবা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশীর সবার স্বপ্ন ছিল তারা একদিন বড় হবে। অনেক বড়। তারা খুনি হবে, এই স্বপ্ন কি কেউ দেখেছিল?
সুতরাং কেবল খুনের বিচার হলেই সব দায় শেষ হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কেন খুনি হয়, কীভাবে খুনের মতো নিকৃষ্ট অপরাধে জড়ায়, তা খতিয়ে দেখতে হবে। আর কোনো শিক্ষার্থী যেন খুনি না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সব জেনেও না জানার ভান করে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকেই এ বিষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। ছাত্রদের সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব যদি বিশ্ববিদ্যালয় পালন না করতে না পারে, তবে অপরাধের দায় তাদের কাঁধেও বর্তাবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী করবে।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি।