ড. মাহফুজুর রহমানের সংগীত ও বাঙালির আনন্দ
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কণ্ঠে আন্দোলিত সুরসংগীতে কথা সাজিয়ে বলেছিলেন, হৃদয় প্রসারিত করে চারিদিকে চেয়ে দেখে ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ জ্ঞান করে শূন্য জীবনে প্রেম ভরে লও। স্বার্থনিমগন হয়ে আপন মনে বসে না থেকে অনুভব করতে বলেছিলেন এভাবে,
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে ॥
পান করি রবে শশী অঞ্জলি ভরিয়া–
সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি–
নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে ॥
এবারের কোরবানি ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকেই নিরস বাঙালির জীবনে সেই রকম আনন্দধারা বইছে। সে আনন্দ এখনো বহমান। মানুষ হেসেই চলছে, হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে সবাই। আজকালকার সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই তা টের পাওয়া যায়। উপলক্ষটা হলো সেই সংগীত। হতে পারে সংগীত মানুষের প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখে, দেশপ্রেম জাগায়, প্রেমবোধে উদ্বেলিত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব সংগীতেই মানুষ বিনোদন খোঁজে। ঈদের তৃতীয় দিন রাত সাড়ে ১০টায় এটিএন বাংলা টেলিভিশনের কর্ণধার ড. মাহফুজুর রহমান আগের ঈদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নিজের চ্যানেলেই ঘন্টাব্যাপী সংগীত পরিবেশন করেছেন। সেই থেকে বাঙালি খিলখিলিয়ে হেসে চলেছে। তবে মাহফুজুর রহমানের সাদামাটা সুরসুধায় নিষ্কলুষ বিনোদন না খোঁজে বাঙালি এখন বক্র সমালোচনায় মাতছে। কারণ সংগীতে যে মাপের গভীরতা থাকবার কথা বিশেষ করে সুর, কথা ও গায়কি, তা নাকি মাহফুজুর রহমানের কাছ থেকে ছিটেফোঁটাও মেলেনি। এমনকি তাঁর পরিবেশন ভঙ্গিমা, বিশেষ করে হস্ত সঞ্চালন, মুখ বা শারীরিক অভিব্যক্তি কিছুই ভালো লাগেনি। কিন্তু একযোগে অনুষ্ঠানটি সবাই দেখেছেন, বলা যায় উপভোগও করেছেন। শিল্পী মাহফুজুর রহমানের উদ্দেশ্য যদি হয় দর্শককে বিনোদিত করা অথবা তাঁর টেলিভিশনে বেশিসংখ্যক দর্শককে টেনে নেওয়া, নিঃসন্দেহে তিনি তাতে পূর্ণ সফল হয়েছেন।
গানের এই অনুষ্ঠানটি প্রচারের আগেই ফেসবুকজুড়ে সাজসাজ রব পড়ে গিয়েছিল। বিচিত্র ট্রলে ভরে ওঠেছিল দর্শকের টাইমলাইন। তারপর অনুষ্ঠান শেষে স্যাটায়ারের বন্যা ভাসিয়ে দিয়েছেন সবাই। কেউ কেউ ইউটিউবে রম্য ভিডিও এর মাধ্যমে মাহফুজুর রহমানের জনপ্রিয়তার সঙ্গে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নেওয়ার প্রয়াসও পেয়েছেন। এটা বেমানান নয় মোটেও। যেমনটা অনুষ্ঠান শেষে কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘যারা বলেন মাহফুজুর রহমান সাহেবের গানের কোনো উপযোগিতা নেই, আমি তাদের সঙ্গে প্রবলভাবে দ্বিমত পোষণ করি। এটা একটা পরীক্ষার মতো। ধারণ ক্ষমতার পরীক্ষা, কঠিন পরিস্থিতি পার করার মানসিক সক্ষমতার পরীক্ষা। আমি পুরো অনুষ্ঠান টানা দেখেছি। আমি পাস করেছি!’
এই পর্যন্ত ঠিকই আছে। রম্য, স্যাটায়ার বা হালের ট্রল আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। সমস্যা হলো ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ মাহফুজুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে বসেছেন। গালাগাল করেছেন। এটা অশোভনীয়ই নয় কেবল সাংবিধানিক বাক স্বাধীনতারও বরখেলাপ। মাহফুজুর রহমানের শখ গান গাওয়া এবং সেটা তাঁর নিজস্ব ঢঙ্গে। তিনি গানের ওস্তাদ নন। উচ্চাঙ্গ সংগীত জানেন না। স্রষ্টা তাঁর গলায় সুর দেননি। জনপ্রিয় রকস্টারদের মতো ফিগার তাঁর নেই। তো কী হয়েছে? তাতে তাঁর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা গান গাইবার ইচ্ছাটাকে দমাতে পারেনি। হোক বেসুরো গলায় বা বেঢপ ঢঙ্গে, তবু তো তিনি গাইছেন।
সবাই বলাবলি করছেন, তাঁর টাকা আছে, নিজের টেলিভিশন চ্যানেল আছে তাই তিনি গায়ের জোরে যা খুশি তাই করছেন। কিন্তু দেশে তো আরো মানুষের টাকা আছে। তারা কী করেন? অবৈধ পথে আরো টাকা কামান, মদ আর অসৎ সঙ্গে গা ভাসান। কুকর্ম আর অপকর্মে অর্থ খরচ করেন। সেসব কর্মকাণ্ডের ভিড় থেকে সময় বাঁচিয়ে কিছুটা সময় যদি মানুষ শিল্পচর্চায় মন দেয় তাতে ক্ষতি কী। হোক না তা ভুলভাল শিল্প। শিল্পের আবার স্ট্যান্ডার্ড কি? শিল্প হলো ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা। সেখানে সব কর্মীর একাগ্র কর্মযজ্ঞই মানিয়ে যায়। মাহফুজুর রহমানের গান গাইবার একাগ্রতাকে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই সুর বাস করে। বাথরুমে হলেও মানুষ তার সুরের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। হালের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মাহফুজুর রহমান না হয় নিজের টেলিভিশনেই গাইলেন। তাতে কার কী ক্ষতিবৃদ্ধি হলো?
আমরা তো এভাবেও ভাবতে পারি, অনুষ্ঠানটি নির্মাণে যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ রয়েছে তাদের ঈদটা খানিকটা হলেও ভালো কেটেছে। দামি মডেল, ভালো লোকেশন, জনপ্রিয় উপস্থাপক, পরিচিত মিউজিশিয়ান, চিত্রগ্রাহক, সেট ডিজাইনার, মেকাপ আর্টিস্ট কিংবা টি-বয় পর্যন্ত এই পোগ্রাম নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। সেখানে অর্থব্যয়ের বিষয়টি কিন্তু আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে রাখতে হবে। এই ব্যয়টা কিন্তু বিপথে নয়!
এ ব্যাপারে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছেন, ‘মাহফুজুর রহমানের গানের কথাগুলো সবই কোনো নারীকে নিয়ে, যাঁকে তিনি খুব ভালোবাসেন। তাঁর সব গানই ভালোবাসা আর বিরহের গান। কোনো নারীকে খুব মিস করছেন, ফিরে আসতে বলছেন। যাঁকে ছাড়া তাঁর কিছু ভালো লাগছে না। সেই নারীর সঙ্গে ছিল তাঁর সুখের জীবন। সেই সুখের জীবন এখন আর নেই তাঁর। ফিলদি ধনীরা সাধারণত এমন স্বীকারোক্তি করে না। তাদের এক গেলে আরেক আসে। কারো জন্য তারা কাঁদে না। এই লোকটি ভিন্ন। লোকটি প্রেমিক। হয়তো আউটডেটেড প্রেমিক কিন্তু প্রেমিক। উদার। সংবেদনশীল।
ধনীদের অনেক রকম স্বপ্ন বা সংকল্প থাকে। কোনো প্রাসাদ বা কোনো জাহাজ বা কোনো ক্যাসিনো কিনে ফেলা। বা বিশাল কোনো জুয়োয় জিতে যাওয়া বা কাউকে ঠকানো, বা কোনো জাতশত্রুকে খুন করা। কিন্ত এই লোকটি ওসব কিছু চাইছেন না, তাঁর নিজের চ্যানেলে একটু গান গাইতে চেয়েছেন, এই যা!’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে সংগীতের গভীর সম্পর্ক আছে। এই বিশ্ব তাঁর কাছে এক মহাসংগীত বলে মনে হয়েছে। ‘শোনা’ নামক প্রবন্ধে কবি লিখেছেন, ‘এই প্রকাণ্ড বিপুল বিশ্বগানের বন্যা যখন সমস্ত আকাশ ছাপিয়ে আমাদের চিত্তের অভিমুখে ছুটে আসে, তখন তাকে এক পথ দিয়ে গ্রহণ করতেই পারিনে, নানা দ্বার খুলে দিতে হয়, চোখ দিয়ে, স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে, নানা দিক দিয়ে তাকে নানা রকম করে নিই। এই একতান মহাসংগীতকে আমরা দেখি শুনি ছুঁই শুঁকি আস্বাদন করি।’ যেমনটা তিনি তাঁর গানেও বলেছেন :
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।--
নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
তো বিশ্বের এই মহাসংগীতে মাহফুজুর রহমান যদি তাঁর স্বাধীনতা, আবেগ আর প্রত্যয় দিয়ে এক বিন্দু জল বা ক্ষুদ্র বালুকণার জোগান দিতে চান, দিক না। আমরা এমন সংগীত ছুঁলাম, শুকলাম, আস্বাদন করলাম আর খানিক আনন্দে না হয় ভাসলাম। কৌতুকে কি আমরা আনন্দ খুঁজি না? মাহফুজুর রহমান নিজেই যেমনটা বলেছেন, সংগীত একটি শিল্প। যাদের সুন্দর মন নেই তারা প্রকৃত শ্রোতা নয়, তারা অসুন্দর পিপাসু! তিনি গানের শুদ্ধতায় বিশ্বাস না করুন কথা কিন্তু ভুল বলেননি। অসুন্দরের পিয়াসি আমরা কেন হতে যাব?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন