শিক্ষা
মেধাবী প্রজন্ম তৈরির প্রতিবন্ধকতা প্রশ্নফাঁস
প্রাথমিক সমাপনী, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধ, সরকারি, বেসরকারি সব ধরণের চাকরিতেই প্রশ্ন ফাঁস সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনা অহরহ ঘটছে। পরীক্ষায় সে যদি চুরি করে বা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেয় তাহলে তার কাছে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না- এটা বলা যায় নিশ্চিত ভাবেই।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘ডিনায়েল সিনড্রোম’ বা অস্বীকার করা। এখন পরিস্থিতি এমন যে সব জায়গাই সত্য কে অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই তো কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন পরীক্ষা বাতিল না করে ফলাফল প্রকাশ করেছে। এটাও ডিনায়েল সিনড্রোমের মধ্যে পড়ে।
যখনই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে তখন একটা বিষয় লক্ষ করা যায় ঐ প্রতিষ্ঠানের দ্বায়িত্বশীলরা দায়িত্বহীন কথা বলেন। যেন বুঝে ও কিছুই বুঝতে পারছেন না। জেনেও জানেন না এমন একটা ব্যাপার লক্ষ করা যায় প্রায়ই। যা ওই প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা।
প্রশ্নফাঁস কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হুঙ্কার, আশ্বাস, ভবিষ্যদ্বাণী কিছুই কাজে আসছে না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডও তা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো শিক্ষার একটি মানদণ্ড প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেখানে যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো বিষয় ঘটে তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী আছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে? কোথায় যাচ্ছে আমার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা? প্রশ্ন বারবার মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ৬-৭ সেট প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে। পরীক্ষার দিন সকালে লটারি করে ঠিক করা যেতে পারে কোন সেটে পরীক্ষা হবে। প্রশ্ন গুলোও হবে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। একটির সাথে যাতে অন্যটি না মেলে। এখন প্রশ্ন হলো সব সেট প্রশ্নই যদি চুরি বা ফাঁস হয় তাহলে? ৭ সেট প্রশ্ন শিখলে একজন পরীক্ষার্থীর বেশ খাটনি খাটতে হবে। যদি কেউ সব সেট শিখে আসে, তাহলে সে অন্তত কিছু পড়াশোনা করতে বাধ্য হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কি আমরা মানুষ হতে পেরেছি? যদি মানুষ হতাম তাহলে প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা কেন ঘটবে? এমন প্রশ্ন বারাবার ঘুরপাক খায় মাথায়। এজন্য সবার আগে আমাদের মানুষ হওয়া জরুরি। তার পর অন্য কিছু।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি, ‘প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্র প্রতিটি পরীক্ষার আগে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলে। এতে যোগ দিয়ে সদস্য ফি দেওয়ার মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। পরীক্ষার আসল প্রশ্নের সঙ্গে মিললে পরে আরো টাকা দিতে হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, এক শ্রেণির অসাধু শিক্ষক, অভিভাবক, কোচিং ব্যবসায়ী ও ছাত্রছাত্রী এর সঙ্গে জড়িত। কথা হলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যে-ই জড়িত, তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা নিন। না হলে তারা লাগাম ছাড়া হয়ে যাবে। এতে ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ঙ্কর খারাপ কিছু অপেক্ষা করবে। জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
শুধু পাবলিক পরীক্ষাতেই নয়, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাতেও প্রায়ই প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ফাঁসকারী চক্র ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ ও মেসেঞ্জারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্য নতুন কৌশলে প্রশ্ন ফাঁস করছে। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এসবের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। সাইবার নিরাপত্তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
দেখা যায় প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কেবল অব্যাহতি দেওয়া হয়। যা এই অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে তা যথেষ্ট নয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের প্রয়োজনে চাকরিচ্যুতির মতো উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করি। শাস্তি না পেলে অন্যরা আস্কারা পাবে- এটাই স্বাভাবিক।
কঠোর গোপনীয়তার পরও কারা কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে? কারা ডিজিটাল ডিভাইস সরবরাহ করে, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। আমরা চাই, আর একটি পরীক্ষায়ও যেন কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়। সাধারণ ও সৎ শিক্ষার্থীরা যেন বঞ্চিত ও বিভ্রান্ত না হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা বিবেকহীন মানুষ এতটাই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছি যে দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করছি না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি একটি দুরারোগ্য। কারণ রোগটি ওষুধে সারছে না। ওষুধের নাম ১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৪ ধারা। ওই আইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ দণ্ডনীয় অপরাধ,যার সাজা জরিমানাসহ ৩ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড। আইনটি পাসের ৩৭ বছরেও এ আইনে কারো সাজা হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে বলে আমার জানা নেই।
২০১৫ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হয়। অথচ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা এখন বেড়েই চলেছে। এ রকম একটি জঘন্য অপরাধে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এমন আত্মঘাতী হয়, তাহলে সমাধানটা কীভাবে হবে? এখন পর্যন্ত কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার কার্যকর সুরাহা হয়নি। প্রতিটি অঘটনের দৌড় তদন্ত কমিটি, সুপারিশ, দু-চারজন গ্রেপ্তার এর চেয়ে আর এগোয় না বিষয়টি। কারা, কীভাবে কাজটি করে বা করছে, তা কখনো জানা যায় না।
জাতিকে প্রশ্ন ফাঁসের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। দেশের শিক্ষাকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। সেটা সম্ভব হবে যদি বিদ্যমান প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও সরবরাহ ব্যবস্থা যুগোপযোগী করা যায়। সম্ভব, যদি প্রশ্নফাঁসকারীদের গলায় সর্বোচ্চ দণ্ডের ফাঁস পরানো যায়। না হলে প্রশ্ন ফাঁস জাতির সর্বনাশ হয়ে দাঁড়াবে। মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে হারাবে একটি জাতি।
লেখক : শিক্ষার্থী, চূড়ান্ত বর্ষ, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়