অভিমত
আলুকে আরো আলোকিত করা প্রয়োজন
আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দিনে দিনে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এটি। বাংলাদেশে আলুর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। তাই আলু দিয়ে কী হয় তা না খুঁজে বরং আলু দিয়ে কী হয় না সেটা বের করা সহজ হবে। অর্থাৎ সব জায়গায় সব তরি-তরকারিতে আলু খাটে বলে মানুষকেও অনেক সময় আলু বলে ডাকা হয়। আলুর পুষ্টিগুণ এবং এর উৎপাদনশীলতার কারণে এটি বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এখন আলু উৎপাদনের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে থাকায় এখানেও একটি প্রধান খাদ্য ভাতের সাথে অথবা ভাতের বিকল্প হিসেবে চালানোর কথা উঠেছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া আলু চাষের জন্য খুবই উপযোগী। সত্তর ও আশির দশকের দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে শুধু দেশী জাতের অল্প পরিসরে আলু চাষ করা হতো। সেচের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পর আশির দশক থেকে আমাদের দেশে দেশি জাতের আলু আবাদের পাশাপাশি বিদেশি উচ্চ ফলনশীল জাতের আলুর আবাদ বাড়তে থাকে। সেই সময় হল্যান্ড থেকে কাঠের বাক্সে করে আসত এক বিশেষ ধরনের বীজআলু যার ফলন দেশি আলু থেকে অনেক বেশি হতো। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে বাংলাদেশে রবি মৌসুমে আলুর আবাদ ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আলু নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করে। বের করা হয় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খাপ খাইয়ে চাষোপযোগী উচ্চফলনশীল জাতের।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক এ ফসলটির। সারাদেশেই আবাদ বাড়তে থাকে এ গোল আলুর। সেই আলুকে সারাবছর সংরক্ষণ করার জন্য এবং এক বছরের আলুকে পরের বছর বীজ আলু হিসেবে ব্যবহারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপন করা হয় অনেক হিমাগারের। আলু আবাদ ও সংরক্ষণের জন্য প্রশিক্ষিত চাষি সৃষ্টি করা হয়। এভাবে এগোতে এগোতে আলু এখন দেশের অন্যতম ফসলের মর্যাদা লাভ করেছে। এখন দেশে প্রায় এক কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়। এত পরিমাণ আলু আমাদের নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আরো অনেক বেঁচে যায়। কিন্তু বিদেশে রপ্তানি করার প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেদিকে তেমন এগোনো যাচ্ছে না।
আলুর বহুমুখী ব্যবহার থাকলেও উদ্যানতাত্ত্বিক ভাষায় এটিকে সবজি বলা হয় না। অথচ আলু সব ধরনের মাছ, মাংসে, ডিম ইত্যাদিতে সবজি হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। আলুর দম, আলুর চপ, আলুর পরোটা, আলুর চিপস, সিঙ্গারা, আলুর পুরি ইত্যাদি আমাদের দেশের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আলুর পুষ্টিগুণ এমন যে সেটি ভাতের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। বাংলাদেশে এখন যদিও প্রধান খাদ্যদ্রব্য হিসেবে চালের অভাব নেই। কিন্তু ভাতের পাশাপাশি একই খাদ্যমানে সমৃদ্ধ আলু খাওয়ার অভ্যাস করতে পারলে আমাদের চাল ও আটার ওপর চাপ অনেকাংশে কমে যেত।
ভাতের পরিবর্তে কিংবা ভাতের বিকল্প হিসেবে সম পুষ্টিমানসম্পন্ন আলু খেলে স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও ভালো হতো বলে মনে করছেন পুষ্টিবিদরা। পৃথিবীর অনেক আলু উৎপাদনকারী এমনকি উন্নত দেশসমূহেও তাদের দেশে আলু প্রধান খাদ্য। আমরাও এতে অভ্যস্ত হলে লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। কারণ আমাদের দেশে বর্তমানে কৃষিতে আলু একটি সম্ভাবনাময় ফসল। এর উপর জোর দিলে হয় এর রপ্তানি বাড়ানো প্রয়োজন হবে নতুবা আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে অভিযোজন করা দরকার। অন্যথায় আলুর উৎপাদন এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তা আর বাড়ালে লাভজনক হবে না।
আলু একটি পঁচনশীল ফসল। বিশেষ ব্যবস্থায় হিমাগারে যদিও বছরখানেক সংরক্ষণ করা সম্ভব। তথাপি তার খরচ বেশি হওয়ায় চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়হীনতার কারণে কৃষকের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। এ বছর (২০১৬-১৭) তা সহজেই বুঝতে পারা গেছে। কারণ এবারে দেশে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু দেশের চাহিদার পরে বহু আলু বেঁচে গেছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সেই আলু সংরক্ষণ করতে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া চাহিদা না থাকর দরুন আলুর মূল্য একেবারে নামেমাত্র। যার ফলশ্রুতিতে পরের বছর (২০১৭-১৮) আলুর আবাদ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে এবারে আবাদ কম হওয়ার কারণে যখন উৎপাদন কম হবে তখন আগামীতে আবার আলুর মূল্য বেড়ে যাবে। এখন বাজারে নতুন আলু উঠেছে। প্রতিকেজি দেশি আলুর মূল্য ৪০ টাকা এবং উচ্চফলনশীল আলুর কেজি প্রতি মূল্য ৫০-৬০ টাকা। অথচ মৌসুমের শুরুতে এ আলুর মূল্য আরো বেশি থাকার কথা। একজন ক্রেতা হিসেবে আমি নিজেও বাজারে গিয়ে কম দামে কিনতে পারলে খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলা বাংলার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেখে মন খারাপ লাগে বৈকি । অপরদিকে এ সময়ে গত বছরের পুরাতন আলু বিক্রি হচ্ছে একেবারে পানির দামে। অর্থাৎ পুরাতন আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১২-১৪ টাকায়।
আলু চাষে আবার সুদিন ফেরাতে কিংবা আলুকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এখনই এখাতে নজর দেওয়া জরুরি। আলু রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন নতুন দেশ খুঁজতে হবে রপ্তানি করার জন্য। এটিকে একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচনা না করে একটি শিল্প-বাণিজ্য পণ্যের মর্যাদায় রপ্তানি করতে পারলে যদি বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় তবে তাই করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে আলুকে ভাতের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হলেও এ ব্যাপারে তেমন সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি। তবে আগে যাই হোক না হোক এখন সময় এসেছে সেই উদ্যোগ নতুনভাবে শুরু করে তাকে আরো সামনে এগিয়ে নেওয়ার দিকে নজর দেওয়ার। তাহলে আলুর উৎপাদন যথাযথ হবে। লাভবান হবে কৃষক। কৃষি অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে যাবে। আর এর জন্য শুধু সরকারি পর্যায় থেকে উদ্যাগই যথেষ্ট নয়। এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও। তাহলেই আলুকে আরো বেশি বেশি আলোকিত করা সম্ভব হবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।