বিজয় গাঁথা

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্বকথা

Looks like you've blocked notifications!

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি আসে। বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়। কিন্তু এই আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তটি হঠাৎ করে হয়নি। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতি ছিল এর পেছনে। এখানে এরই অংশ বিশেষ উল্লেখ করা হলো।

৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের দুর্বল দশা স্পষ্ট হতে থাকে। যৌথবাহিনী বাংলাদেশের অনেকটা অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। কার্যত পাকিস্তানি বিমান ও নৌবাহিনী অকেজো হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় ছড়িয়ে পড়েছিল নানা ধরনের গুজব। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. মালিক জেনারেল নিয়াজীকে গভর্নর হাউসে ডেকে পাঠান। এ সময়ের সেনাবাহিনীর প্রেস কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাতে পাকিস্তনি বাহিনীর সংকটের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নিয়াজী গভর্নরের সামনে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। পাকবাহিনীর দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে গভর্নর জানান তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে বার্তা পাঠাবেন যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররাও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন। নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন।

পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপট রচিত হয় ৯ ডিসেম্বর থেকেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছিল। অনেক শহরে হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। পাকবাহিনীর সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে আসছিল ঢাকার দিকে। এমন একটি পরিস্থিতিতে ৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এ এম মালিক ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠান। অতিদ্রুত যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ইয়াহিয়া খান গভর্নর মালিক ও সেনাপ্রধান নিয়াজী উভয়কেই তাদের বিবেচনা মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেন। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি পাঁচ দফার একটি প্রস্তাব পাঠান। এগুলো হচ্ছে : ১. অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, ২. সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে হবে, ৩. পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অন্যসব নাগরিক যারা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে ইচ্ছুক তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে হবে, ৪. ১৯৪৭ সাল থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করছে সেই সব নাগরিককে নিরাপত্তা বিধান করতে হবে এবং ৫. নিশ্চয়তা দিতে হবে এদের কখনো দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে না।

তবে এই প্রস্তাব যে তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে তেমন মনে হয়নি। এদিকে গভর্নর মালিক পরবর্তী নির্দেশনার জন্য রাওয়ালপিণ্ডির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় গভর্নর হাউসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি সভা ডাকেন। এই সংবাদ সকাল সাড়ে ৯টায় ভারতীয় বাহিনীর সিগন্যাল ইন্টিলিজেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল পি সি ভাল্লা পেয়ে যান। তিনি দ্রুত টেলিফোনে এয়ার ভাইস মার্শাল দেবাসেরকে জানান। শিলংয়ে অবস্থিত ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের তিনি একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন এই সময় গভর্নর হাউজে বিমান আক্রমণ করলে আত্মসমর্পণের বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে। সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী সভায় কর্মকর্তারা যোগ দেওয়ার আগেই ভারতীয় বিমান আক্রমণে গভর্নর হাউসে বেশ কয়েকটি বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। গভর্নর মালিক ভীত হয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। ১৩ অথবা ১৪ ডিসেম্বর রাতে নিয়াজী পাকিস্তানের সেনাপ্রধান  জেনারেল হামিদকে অনুরোধ করেন যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নেন। ১৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান নিয়াজীর কাছে বার্তা পাঠিয়ে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন।

নিয়াজীর কাছে প্রেসিডেন্টের বার্তা এসে পৌঁছায় বিকেল ৩টায়। এরপর নিয়াজী এবং রাও ফরমান আলী ছুটে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভেকের কাছে। তাঁরা অনুরোধ করেন ভারতের সাথে যোগাযোগ করে যাতে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করেন। স্পিভেক জানান এ ধরনের আলোচনার যথাযোগ্য পদমর্যার তিনি নন। রাও ফরমান আলী প্রাসঙ্গিক একটি বার্তা প্রস্তুত করে এনেছিলেন। তাঁরা বার্তাটি স্পিভেকের কাছে দিয়ে চলে আসেন।

বার্তাটিতে তাঁরা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের জীবনহানির কথা বলে একটি মানবিক আবেদন জানান। এর সম্মানজনক সমাধানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবগুলো ছিল নিম্নরূপ :

ক. যুদ্ধবন্ধ ও পূর্বপাকিস্তানে সংঘটিত সব শত্রুতা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।

খ. জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে প্রশাসন হস্তান্তর করতে হবে।

গ. জাতিসংঘকে নিশ্চিত করতে হবে—

১. পাকিস্তানের সব সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা যাতে করা হয়।

২. পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সব পশ্চিম পাকিস্তানি সাধারণ মানুষ,  বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সব অস্থানীয় অভিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৪. ১০৭১ সালে যারা পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতা করেছিল তাদের ওপর কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এর নিশ্চয়তা দিতে হবে।

এই প্রস্তাবনার একটি কপি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাও ফরমান আলীর হাতে দেওয়া হয় গভর্নরের কাছে পৌঁছানোর জন্য। তবে বার্তাটি ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে না দিয়ে একটি কপি ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৭১-এ ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান লে. জেনারেল জ্যাক জ্যাকব তাঁর গ্রন্থে বলেছেন যে, ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতাস্থ কনসুলার অফিসের একজন কূটনীতিক তাঁকে স্পিভেকের সাথে নিয়াজীর সাক্ষাৎ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি জানান এই সময় যুদ্ধ বন্ধ বা আত্মসমর্পণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। জ্যাকব তখন কলকাতায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসুল জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনকে টেলিফোন করেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবুও জ্যাকব বিষয়টি পুনরায় খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কনসুল জেনারেল নতুন কোনো তথ্য দেননি। এরপর জ্যাকব সেনাবাহিনী প্রধান মানেকশকে টেলিফোন করে অনুরোধ জানান তিনি যাতে দিল্লিতে নিয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এম্বাসেডরের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। এম্বাসেডর জানান এ ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে তাঁর জানা মতে স্পিভেক তাঁর বার্তাটি পাকিস্তানে নিয়োজিত তাঁদের এম্বাসেডরকে পাঠিয়েছেন এবং এম্বাসেডর তা পাঠিয়ে দিয়েছেন ওয়াশিংটনস্থ স্টেট ডিপার্টমেন্টে। পরে কিসিঞ্জার স্বীকার করেছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রস্তাবটি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে একদিন অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

বার্তাটি মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পান। তিনি পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে যোগাযোগ করে। নিয়াজী আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেন।

এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই আত্মসমর্পণের পথ নিশ্চিত হয়।

লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়