উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা
ফল বিপর্যয়ের কারণ কী?
এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে ২৭ হাজার ৭০৮ জন।
১০টি বোর্ডে পরীক্ষার্থীদের গড় পাসের হার ৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ হিসাবে গড় পাসের হার কমেছে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
১০ বোর্ডে এবার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। গত বছর জিপিএ ৫ পেয়েছিল ৭০ হাজার ৬০২ জন। এ হিসাবে জিপিএ ৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ২৭ হাজার ৭০৮ জন।
এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। এক হাজার ১৩৩টি প্রতিষ্ঠান। গত বছর এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৪৭টি।
অন্যদিকে, কেউ পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। ১০ বোর্ডে ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪। সব মিলিয়ে এটিকে একটি ফল বিপর্যয়ও বলা যেতে পারে।
এবার আসা যাক, কেন এমন ফল হলো—প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ ও সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে নতুন কিছু পরিবর্তনের কারণে? নাকি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে?
যদি ধরি, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, গত বছরগুলোতে দেশব্যাপী প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। বস্তুত তা কিন্তু হয়নি। তবে রাজনৈতিক বিপর্যয় কিন্তু বেশ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। কারণ, শিক্ষার্থীরা নিরবচ্ছিন্ন মেজাজ নিয়ে পড়ালেখা করতে পারেনি।
অন্যদিকে, সৃজনশীল পরীক্ষায়ও শিক্ষার্থীরা একধরনের অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে কেন এই বিপর্যয়? নাকি এটিও সরকারের কোনো ‘পলিসি’?
এসব বিষয় বিতর্কের জন্ম দেবে। তবে কারণ হিসেবে একটি বিষয়কে এগিয়ে রাখা যেতে পারে। আর তা হলো অন্য বোর্ডের প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়া।
নতুন প্রশ্নপত্র পদ্ধতি ও মফস্বল এলাকায় সমান সুযোগ নিশ্চিত না হওয়াও যোগ হয়েছে এর সঙ্গে।
আগে নিজ নিজ বোর্ড প্রশ্নপত্র তৈরি করত। তবে এ বছর থেকে নিজ বোর্ড বাদ দিয়ে বাকি সাত বোর্ডে ২৮ সেট প্রশ্নপত্র থেকে যেকোনো চার সেট পছন্দ করা হয়েছে। ওই প্রশ্নপত্র কোন বোর্ডের, তা কারো জানার অবকাশ ছিল না। বাস্তবে না জানাটাই যুক্তিসংগত ও নৈতিক।
আগে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বোর্ডের অতীতের প্রশ্ন দেখে সিলেক্টিভ পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত। কিন্তু এ বছর তাদের এ প্রস্তুতি তেমন কাজে আসেনি।
যশোর বোর্ডের ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা আমার কোনো বিশ্লেষণে পড়ে না। তবে এতটুকু সন্দেহ করছি, তাদের প্রশ্নটি অন্য এমন কোনো বোর্ডের প্রশ্ন পড়েছে, যে বোর্ডের প্রশ্নপদ্ধতি যশোর বোর্ডের প্রশ্নের চেয়ে বেশ ভিন্ন হয়ে থাকে।
পার্বত্য তিন জেলার ফল বিপর্যয়ের পেছনে এসব কারণের পাশাপাশি তাদের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক বিষয়টিও বরাবরের মতো কাজ করেছে বলে আমি মনে করি।
তবে রাঙামাটিতে এ হার বেশ কমেছে, মাত্র ৪৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিষয়গুলো ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী এই ফল বিপর্যয়ের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করেছেন। তবে এর চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছিল এ বছরের কোমলমতি এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। তাদের ফল ২০১৪ সালের চেয়ে হার হ্রাস পেলেও সে ব্যবধান বেশি ছিল না।
২০১৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা এ বছর হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে। সে হিসেবে এইচএসসি পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়ের পরিমাণটাই বেশি হয়েছে। অথচ এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশি খারাপ ছিল।
একটা বিষয় বেশি খারাপ লাগছে। তা হলো মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ফল নিয়ে সরকারের দাপ্তরিক কোনো বিশ্লেষণ নেই। শিক্ষাসচিবও বিষয়টি অকপটে স্বীকার করলেন। এটা কি থাকা উচিত নয়? যুগের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কারিকুলামের যেমন পরিবর্তন বিশ্লেষণ হচ্ছে, তেমনি এর ফল নিয়েও তো বিশ্লেষণ থাকা উচিত। ‘কজ অ্যান্ড ইফেক্ট’ অ্যানালাইসিস না হলে তো ‘পলিসি ইমপ্লিমেনটেশন’ হবে না। এর ধরনের পরিবর্তন কতটুকু যৌক্তিক?
সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার ব্যবস্থায় নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমাদের শহরের ১০টি স্কুল-কলেজকে চিন্তা করলে তো হবে না। আমাদের শহর-নগরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের কথাও চিন্তা করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যেখানে ভালো শিক্ষকের অভাব প্রায় প্রতিটি বিষয়ে, সেখানে আবার সৃজনশীল পদ্ধতি! শিক্ষার্থীরা তো দূরের কথা, স্বয়ং শিক্ষকরাই এ পদ্ধতির সমাধান করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
তার ওপর এবার আবার নিজের বোর্ডের প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারেনি। দিয়েছে ভিন্ন বোর্ডের প্রশ্নে। তারা হঠাৎ করে এর মুখোমুখি হয়েছে। হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সামগ্রিকভাবে কতটুকু যৌক্তিক ছিল?
লেখক : সাংবাদিক