স্বাগত ১৪২৫
মঙ্গলে শুচি হোক আবহমান বাংলা
মৃদুমন্দ দক্ষিণা মলয়ে কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পত্রে লাল পাঁপড়ির দোলা। পথপাশে সোনালুর হলুদ আর জারুলের বেগুনিতে মোহাবিষ্ট পাখপাখালির কিচিরমিচির। ঈষাণ কোণে মেঘেদের কৃষ্ণসাজ। আকাশজুড়ে চমকিত বিদ্যুৎ আর গুড়ুম গুড়ুম গর্জন। ঝড় ও বৃষ্টির যূথবদ্ধ তাণ্ডব নিয়ে এলো আম কুঁড়ানির ছেলেবেলা আর শিল কুঁড়ানির মেয়েবেলা। আবার নিমিষে গনগনে সূর্যের উষ্ণ ঝলকানি। পিপাসার্ত প্রাণিকূলের ঢকঢক জলপান। বাজারজুড়ে বিচিত্র ফলসম্ভার। নতুনের আবাহন এই তো। তেজোদীপ্ত বৈশাখ এই তো। শুভ নববর্ষ ১৪২৫।
সূর্য, বক-মাছ, হাতি, পাখি, সাইকেলে মা-শিশু, টেপা পুতুল, মহিষসহ চারটি পাখি ও জেলে –এই আট প্রতীকে রাজধানীতে মঙ্গল শোভাযাত্রা হলো সাতসকালেই। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র ও নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে হাত ধরাধরি করে নতুন দিনের শপথও নেওয়া হলো। শুধু মানুষের মুখ ও মুখোশে নয়, রাঙিয়ে তোলা হলো অবহেলার নাগরিক দেয়ালও। আজ যে দিকে তাকানো যায় রঙের ছড়াছড়ি। সুন্দরের পূজারিরা দলবেঁধে বাড়ির বাইরে। সবার সম্মিলিত স্রোত প্রাণের বৈশাখি উৎসবে। হোক না একদিন তবু আমরা দুঃখ ভুলে যাওয়া সুখী মানুষ। আজকের চলন-বলন সবটাই অশান্তিকে পাশ কাটানো শান্তির পায়রা যেন। আজ যা দেখা যায় সবটাই মঙ্গলময়। যা করা হয় সবই কল্যাণকর। কোনো নিন্দামন্দ নয়, এতটুকু ঘৃণা নয়; মাখামাখি ভালোবাসবার অনন্য সুসময় আজ পহেলা বৈশাখ।
অহিংস মানুষের এই যে উৎসবের আরাধনা, আনন্দধারায় পুণ্যস্নান; বাঙালিকে একদিন পৌঁছাবেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সুবর্ণ বন্দরে। সেদিন ধর্মের নাম নিয়ে কারো শালীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা আর ভিন্নমতালম্বীদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাবোধ অর্জনের মাধ্যমে আমরাও হবো সেদিন সুসভ্যতার আইকন। তেমন একটা দিন বা তেমন একটা সময় অর্জনের নিখাদ মহড়াই তো নববর্ষের দিন। এমন দিন বারবার আসুক। এমন মোহময় সময় চিরস্থায়ী স্থিতি পাক।
এই সময় হাজারো ইতিবাচক পরিসংখ্যানে ঋদ্ধ বাংলাদেশের খেড়োখাতা। বাঙালির কাজ প্রশংসা পাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আমাদের নানা অর্জন বিশ্বস্বীকৃতিও পাচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের সামগ্রিক শুভবোধ, শ্রেয়বোধ, বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনার লয় ঘটে চলেছে মারাত্মভাবে। আমরা এখন ইন্টারনেটের সুপার কমিউনিকেশনের যুগে বাস করি। নিমিষে পড়ে ফেলা যায় মানুষের অন্দরমহল। বেপথো নাগরিক এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ছলনা, ভাণ অথবা শঠতার কিছুই আর লুকোছাপা থাকে না। যা সত্য ও প্রেমময় তা চিরকাল সূর্যের ন্যায় আলোকোজ্জ্বল। মিথ্যা কিংবা ঘৃণার অন্ধকার অমাবস্যা বরাবরই অভিশাপ। আমরা কোনো এক শনি দেবতার বর পেয়ে অসত্য ও অসুন্দরের অভিশাপ বয়ে বেড়াতেই ভালোবেসে চলেছি। রাষ্ট্র তার নাগরিকে জন্য কী করতে চায় অথবা কী করে চলেছে তা অনেকসময় অস্বচ্ছতার ঘোলাজলে হাবুডুবু খায়। কাকান্ধ সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের চালাকি অথবা অভিনয় আমজনতার অগোচরে না থাকলেও অলীক অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় মূল্যবান সময় ব্যয় করে ফেলে নির্বিকার ক্ষমতাসীনরা। তাদের মনে থাকে না অমর কথাকার লিও তলস্তয়ের ‘মিথ্যাবাদী’ গল্প। ভেড়া পাহারা দেয় ছেলেটি, নেকড়ে দেখেছে ভাণ করে ডাকতে লাগল, নেকড়ে, নেকড়ে, শিগগির এসো তোমরা!’ চাষিরা ছুটে এসে দেখে, কিছুই নয়। এভাবে বার দুই তিন করার পর সত্যিই একদিন নেকড়ে এলো। ছেলেটা চেঁচাতে লাগল, এসো শিগগির, নেকড়ে!’ চাষিরা ভাবল, বরাবরের মতো তামাসা করছে ছেলেটি। তাই কেউ এলো না। নেকড়ে দেখল ভয়ের কিছুই নেই, নির্বিঘ্নে গোটা ভেড়ার পাল ছাড়খার করল সে। শাসক ও শাসিতরা এখনি সতর্ক না হলে, জানি না আমরাও কোনো একদিন মিথ্যা নেকড়েরূপী অশনিসংকেতে মারাত্মক বিপর্যস্ত হবো কি না।
এবারের বর্ষবরণ উৎসবের প্রতিপাদ্য হলো মিস্টিক কবি লালন ফকিরের গান, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।‘ যেকোনো উপায়েই হোক একমানুষের সাথে গাঁথা আছে আরেক মানুষ। ভিন্নমত থাকুক, জাতিভেদ থাকুক, আলাদা ধর্ম থাকুক কে বলতে পারে সবার জন্মসূত্র এক না? লালন খুব সত্যি করে বলেছেন, এই মানুষে মানুষ গাঁথা/গাছে যেমন আলোকলতা। সেই মানুষের সাধনা না করলে নিশ্চিতই মানুষকে তার মূল হারিয়ে ফেলতে হবে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের এক ও অভিন্ন মানুষ হয়ে ওঠবার দীক্ষা দেয়। কিন্তু সেই দীক্ষাটা কেমন যেন একদিনের হয়ে ওঠে। আজ একতারা-দুতরা বাজিয়ে একপ্লেটে সবাই কাঁচামরিচ পান্তা খেয়ে পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানায় মেতে উঠলাম। ভুলে থাকলাম খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, মাস্তানিসহ বিচিত্র অপরাধ। আর নববর্ষের রাত পোহালেই আবার ফিরে যাব বর্ণবৈষম্যের গালমন্দে আর ধর্মবিদ্বেষের মধ্যযুগে। ফিরিয়ে আনব একদিনের জন্য লুকিয়ে রাখা মন ও মগজের অস্পৃশ্য অমানুষটাকে। আমরা তো পারতাম আজকে দেখানো ভালোবাসার সব রাগ সব রং বছরজুড়ে ছড়িয়ে দিতে।
তবু সমতলে কিংবা পাহাড়ে, সমুদ্রে কিংবা ভূতলে, দেশে কিংবা প্রবাসে যেখানে যত বাঙালি আছে সবার বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। জরা ঘুচে যাক, গ্লানি মুছে যাক। রাবীন্দ্রিক রসের আবেশরাশিতে ভরা থাক সবার বিমুগ্ধ প্রাণ। বিশ্বমানুষ হয়ে উঠুক একে অপরের পরমাত্মীয়। আমাদের হাজার শোক থাকুক, বিয়োগব্যথা থাকুক, সহস্র বঞ্চনা থাকুক সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমরা আমাদের অক্ষয় মনুষত্যবোধটাকে জাগিয়ে রাখতে যুদ্ধ করে যাব। তবেই মঙ্গলে শুচি থাকবে আবহমান বাংলা। আজ বর্ষবরণের দিনে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের অমর পঙক্তিমালা আবার স্মরণ করি-
যতদিন পৃথিবীতে জীবন রয়েছে
দুই চোখ মেলে রেখে স্থির
মৃত্যু আর বঞ্চনার কুয়াশার পারে
সত্য সেবা শান্তি যুক্তির
নির্দেশের পথ ধরে চলে
হয়তো বা ক্রমে আরো আলো
পাওয়া যাবে বাহিরে –হৃদয়ে :
মানব ক্ষয়িত হয় না জাতির ব্যক্তির ক্ষয়ে।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন