আন্তর্জাতিক
পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যাবেন ইমরান খান?
দৃশ্যত দেখা গেল, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনীতির তৃতীয় পক্ষের এখনকার সেনাসমর্থিত প্রতিভূ সাবেক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই-র প্রধান দেশটির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন। কিন্তু অন্তর্গত নাটকীয় দৃশ্যাবলিকে এমন সহজ সমীকরণে মেলানো সম্ভব হবে না। পাকিস্তানের ক্ষমতাকেন্দ্রিক এই নাটকীয়তা শেষ পর্যন্ত কমেডি হবে নাকি গ্রিক ট্র্যাজেডির আধুনিক সংস্করণ হবে, তা বলবে ভবিতব্য।
সামরিক শাসন অথবা সেনা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ভারত ছাড়া প্রায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ারই এক অমোঘ নিয়তি। অতীতে আমরাও সেনাশাসনে জেরবার হয়েছি। তবে পাকিস্তান খানিকটা বেশিই এই দুর্মর নিয়তির ঘেরাটোপে বন্দি। সেখানকার স্বেচ্ছাচারী সেনাশাসকরা অতীতে নিজেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর দেশটাকে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে অকার্যকর রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামের ভূখণ্ড হারিয়েছে, কাশ্মীরে সংকট বাড়িয়ে তুলেছে এবং নিজেদের দেশকে জঙ্গি আস্তানায় পরিণত করেছে। তারপরও সেনাবাহিনী ভাবে তারাই একমাত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের হকদার। এবং যেটুকু ছিটেফোঁটা নামকাওয়াস্তে পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে, তাও ওই সেনা খুঁটির ওপর ভর দিয়েই। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী যাকে ইচ্ছে ক্ষমতায় বসাতে পারে, যাকে ইচ্ছে টেনেহিঁচড়ে নামাতেও পারে। সামরিক বাহিনীর ইচ্ছানুগ কাজগুলো করে দেয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও এমআই। এখানকার আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ ওই সেনাবাহিনীরই তল্পিবাহক। এমন এক পরিস্থিতিতে একাত্তর বছর বয়সী দেশটায় মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো বেসামরিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। আর সেই স্বর্ণালি গণতন্ত্রে সেনাবাহিনীর কাঠি থাকবে না, তা কী করে হয়?
দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকা ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ বা মিস্টার টেন পার্সেন্টখ্যাত আসিফ আলি জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারছিল না এমন নয়। তাহলে সেনাবাহিনীকে কেন নতুন সূর্যের দিকে ছাতা ধরতে হলো? পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর দুর্নীতির রেকর্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটেছে নওয়াজ পরিবার বনাম ভুট্টো পরিবার। এই রাজনীতিবিদরা সেনাবাহিনীর তাল সালাম দিতে দিতে নিজেদের আখেরও গুছিয়েছে ভালোমতো। দেশের স্থিতিশীলতা, সুশাসন বা সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ এদের কাছে মুখ্য থাকেনি। তাদের দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণ রাজনীতির মাফিয়াতন্ত্র বরাবর পাকিস্তানের শত্রুপক্ষকে খুশি করেছে। এমন বাস্তবতায় রাজনীতির ঘোড়ার রেসে নতুন একজন তেজি ঘোটকের দরকার ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। কার্যত ৬৩ ভাগ তরুণ ভোটারের দেশে ইমরান খানের প্রতি ঝোঁক বাড়ছিল সবার। আর সেই ঝোঁকে ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে সেনাবাহিনী। এই বাহিনী পূর্বাপর হিসাব করে মিলিয়ে দেখেছে পুরোনো নওয়াজ শরিফ কিংবা অপেক্ষাকৃত নতুন বিলাওয়াল ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা রাখলে তাদের উচ্চাশা বাস্তবায়ন হবে না। অতএব, বড় দল মাইনাস। গেল কয়েকটি নির্বাচনে তৃতীয় স্থান পাওয়া ইমরান খান হয়ে উঠল সামরিক বাহিনীর তুরুপের তাস।
নির্বাচন-পূর্ববর্তী জরিপকে সম্পূর্ণ শুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়ে এরই মধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে, ইমরান খান ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুজন দুজনার। এই নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছিল এবং এযাবৎকালের সর্বাধিক ব্যয় করার অধিকারও তারা পেয়েছিল। এর আগে আদালত ব্যবহার করে পানামা কেলেঙ্কারির আইওয়াশ তদন্তের ওপর ভর করে নির্বাচনের আগ দিয়ে নওয়াজ শরিফ ও তাঁর কন্যাকে জেলে পুরতে সক্ষম হয়েছিল ইমরান খানকে ক্ষমতায় আনার কারিগররা। নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে দীর্ঘ সময় নিয়ে। সাংবাদিকদেরও কেন্দ্র ভিজিট করার অধিকার সীমিত করে রাখা হয়েছিল। সেনাবশংবদ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছাপাখানা থেকে ব্যালট পেপার কেন্দ্রে নেওয়া এবং ভোট শেষে নির্বাচন কমিশনে পৌঁছানোর কাজটি করেছে ওই সেনাবাহিনীই। এমনকি অভিযোগ উঠেছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে সেনা গোয়েন্দারা পিএমএল(এন), পিপিপি বা অন্য ছোট দলের অনেক প্রার্থীকে জোরজবরদস্তিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিস্ময়কর সত্য হলো, এসব প্রার্থীকে মার্কা দেওয়া হয় ‘জিপ গাড়ি’। এর মাধ্যমে সামরিক বাহিনী নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়াস পেয়েছে। যাতে কোয়ালিশন সরকার হলে সেই সরকারে সেনাবাহিনীর অংশীদারত্ব থাকে।
একমাত্র ইমরান খান ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দল এই নির্বাচনকে কারচুপির নির্বাচন আখ্যা দিয়ে তা বর্জন করেছে। এই ইমরান খানকেই গেল বেশ কয়েক বছর ধরে নার্সিং করে গেছে সামরিক বাহিনী। এর আদ্যোপান্ত জানতে হলে আমাদের সাত বছর আগের ইতিহাস খুড়তে হবে।
২০১১ সালের ৩০ অক্টোবরে লাহোর সমাবেশের আগে রাজনীতিতে ইমরান খানের অবস্থান ছিল অনেকটা ‘কেউ নয়' ধরনের। যদিও তাঁর দল ১৯৯৭ সাল থেকে পাকিস্তানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আসছে। পাকিস্তানের গতানুগতিক বংশানুক্রমিক রাজনীতির ধারার বাইরে ব্যতিক্রম হিসেবে পরিচিত ইমরান খানের ওই রাজনৈতিক সমাবেশে হাজির হন লক্ষাধিক জনতা। যাদের অধিকাংশই ছিলেন বয়সে তরুণ। পর্যবেক্ষকদের দাবি, সেনা গোয়েন্দাদের ছত্রছায়াতেই এমন একটি সফল সমাবেশ করাতে পেরেছিলেন ইমরান। মূলত তখন থেকেই রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। এবারের নির্বাচনের আগ দিয়ে শাসকগোষ্ঠী নওয়াজ গংদের বিরুদ্ধে মারাত্মক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাদের বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও প্রচ্ছন্ন সমর্থন পায় ইমরানের খানের ‘মুভমেন্ট ফর জাস্টিস’। এই সময়ে ভারত ও আমেরিকা বিরোধিতা, তালেবান বা লস্করে তাইয়েবার মতো সেনা সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতি নমনীয় অবস্থান, তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা ইত্যাদি অনুষঙ্গ যাচাই করে ইমরান খানের তুলনায় অন্য কোনো রাজনীতিবিদ সামরিক বাহিনীর নেকনজর পাওয়ার দাবিদার হতে পারেনি।
ইমরান খান পাকিস্তানকে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। তারওপর ইমরান খানে ব্যক্তিজীবনে ইসলাম ধর্ম চর্চার বালাই নেই কিন্তু মুখের বুলিতে ধর্মটা সবার আগে। এমন ধর্মব্যবসায়ীই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একনাম্বার পছন্দ। পাকিস্তানের জাতির জনক মুহাম্মদ আলি জিন্নাহও ছিলেন ঠিক একই ধাঁচের। নিজে ধর্মের ধার ধারতেন না, ব্যক্তিজীবনে ধর্মাচারী ছিলেন না, কিন্তু দেশভাগ করেছিলেন ধর্মের ভিত্তিতে। কাজেই ইমরানের খানের রাজনীতিতে উত্থান তাঁর পরিশ্রমের ফসল নাকি সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের নীলনকশা, তা নির্ভর করবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গতিবিধি কী হয়, তার ওপর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এরই মধ্যে ইমরান খানকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পালকপুত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আর যে সেনাবাহিনীকে আগে বলা হতো রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র, তাদের এখন বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর রাষ্ট্র। কাজেই এই সেনারাষ্ট্রের জলপাই রঙের উর্দি পরে ইমরান খান অতীত রাষ্ট্রনায়কদের থেকে কতটা ব্যতিক্রম ও জনস্বার্থবাদী শাসন উপহার দিতে পারবেন তা বড় প্রশ্নসাপেক্ষই। পারমাণবিক সক্ষমতা ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজের দেশ কিংবা বিশ্ব শান্তিতে দারুণ কোনো ভূমিকার নজির রেখেছে এমনটা আমরা দেখিনি। আর এখন ইমরান খানকে ঘুঁটি করে পরোক্ষ সেনাশাসন নতুন কোনো চমক দিতে পারবে এমনটা পাকিস্তানের বড় মিত্ররাও আশা করে না।
ধারণা করা যাচ্ছে, ইমরান খান একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে হাজির হতে পারবে না। এখানেও সেনাবাহিনীর কারসাজি লক্ষ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ইমরান খানকে একক ক্ষমতায় ক্ষমতাসীন করলে সেনা এজেন্ডা বাস্তবায়নে গড়িমসি করতে পারেন তিনি। ক্ষমতাকে জোটের ভিতর বিভক্ত করা গেলে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া তত্ত্ব ‘ভাগ কর শাসন কর’র দুর্বলতার সুফল ঘরে তুলতে পারবে সেনাবাহিনী। কাজেই সেনাবাহিনীর ছকে খেলে ইমরান খান গোল করলেন বটে ফলাফলটা ওই বাহিনীর হাতেই রাখা থাকল।
কিন্তু সেনা ছাউনিতে নিজের আত্মমর্যাদার পা রেখে জোর গলায় কথা বলার অধিকার কোথায় পাবেন ইমরান খান? পারিবারিক জীবনে বহুবিবাহ কিংবা বান্ধবী সংসর্গে পেরেশান ইমরান খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাটা কি ক্রিকেট খেলার মতো উপভোগ করতে পারবেন? বরাবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বনকারী ইমরান খানের কাছ থেকে আমাদের খুব বেশি আশা নেই। তবু পাকিস্তানের ধর্মীয় উগ্র জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্রমবর্ধনশীল বোমা হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি, দুঃশাসন , দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অতীত অন্ধকার ভেদ করে যদি বিশ্বমানুষকে আলোর মুখ দেখাতে পারেন আমরা নিশ্চিতই সাধুবাদ জানাব।
ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘দ্য ট্র্যাজিক্যাল হিস্ট্রি অফ লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ ডক্টর ফস্টাস’ নাটকে দেখতে পাই, অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ফস্টাস জাগতিক ভোগ-বিলাসের জন্য শয়তান লুসিফারের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে দেন। পরিণতিতে নিদারুণ অনুতাপে করুণ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন তিনি। একালের লুসিফারের কাছে ‘হার্ট অ্যান্ড সোল’ বন্দক রাখা ফস্টাসরূপী ইমরান খানের পরিণতি দেখতে আপাতত আমাদেরকে আগামী মহাকালের কাছে অপেক্ষার আবেদনটাই জমা রাখতে হবে।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।