নদীভাঙন
নড়িয়ার কান্না নগরে পৌঁছাবে কবে?
বাংলাদেশের নদীপাড়ের মানুষের জন্য ভাঙন এক অবর্ণনীয় দুঃখ আর ভয়াল ট্র্যাজেডির নাম। ফি বছর এমন দুঃখের অতল সাগরে হাবুডুবু খায় অগণন মানুষ। আজ যিনি ভূ-সম্পদে সম্মানীয় জোতদার বা সমাজসেবক একরাতেই তিনি হয়ে যান সহায়সম্বল ও গৃহহীন এক নিঃস্ব মানুষ। যার মোটে থাকে যৎসামান্য ভিটেমাটিতে স্বামী বা স্বজনের কবরটুকুর স্মৃতির অমূল্য সম্পদ তিনি হয়ে ওঠেন ভাবলেশহীন এক ঊন মানুষ।
এভাবে প্রতিবছর পদ্মা, মেঘনা বা যমুনা হাজারো মানুষের শেকড় কেড়ে নেয়। বগুড়ায় ভাঙ্গে, হাতিয়ায় ভাঙ্গে, ভাঙ্গে শরীয়তপুরে। এবারের সেই শরীয়তপুরের নড়িয়া হয়ে ওঠেছে ভাঙনের করুণ কাব্য।
কিন্তু নড়িয়ার কান্না নগরে পৌঁছে না। দেবতারা আরাম আয়েশে থাকেন বেড়িবাঁধবেষ্টিত ওই সুরক্ষিত নগরে। একদিন নড়িয়ার মানুষ, প্রাণী, ফুল, পাখি, গাছ ও মাটির কান্নারা অভিশাপ হয়ে নগরে কড়া নাড়বে নিশ্চিত। নির্বিকার নগরের শানশওকতে বয়ে যায় যদি আগুনঝড়? সেদিন কি দেবালয় রক্ষা পাবে?
শরীয়তপুরের নড়িয়ায় প্রমত্তা পদ্মার ভাঙনে গত তিন মাসে গৃহহীন হয়েছে ছয় হাজার ১০০ পরিবার। শুভগ্রাম, বাঁশতলা, পূর্বনগিয়া, উত্তর কেদারপুর, দাসপাড়া, পাঁচগাঁওসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রামে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেক গ্রাম ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অন্তত ১০ হাজার পরিবার। নদী গ্রাস করছে হাসপাতাল, প্রার্থনালয়, হাটবাজার ও বাড়িঘর। চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে হাজারো অসুস্থ্য মানুষ। যে নারীটিকে গর্ভে সন্তান নিয়ে শেষ সময়ে এক অনিশ্চয়তার আতঙ্কে বাস করতে হয়,তার মানসিক অবস্থাটা কি আমরা খেয়াল করি? তারপর কাছের হাসপাতালের সেবা না পেয়ে দূরে কোথাও যখন ছুটতে হয় তাকে তার সেই দুর্মর কষ্ট ও অসহায়ত্ব কি আমরা অনুভব করতে পারি? ঘরের ছাদ বঞ্চিত ক্ষুধার্ত শিশুটি যখন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সামান্য মমতা ও ভালোবাসার আশায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার সেই করুণ চাহনি কি আমাদের হৃদয়ে আদৌ দাগ কাটে? যে বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে অসুস্থ জীর্ণশীর্ণ শরীরের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়, সেই তিনিই যখন নিরাশ্রয় ও ওষুধ বঞ্চিত হয়ে পড়ে তার পাহাড়সমান ব্যথারা কি আমাদের মগজের বিয়োগান্তক স্নায়ুদের স্পর্শ করে?
না করে না। আমরা মানুষ হয়ে মানুষের দুঃখ বুঝবার স্তর পাড় হয়ে এসেছি। আমাদের চিন্তারা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কেন্দ্রীভূত ও আড়ষ্ট। তাই যদি না হবে, যে দেশে বিলিয়ন ডলারের বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু আছে সেই সক্ষম দেশে পরিকল্পিতভাবে নদী শাসন করে মানুষের জন্মভিটা সুরক্ষিত রাখবার সুবুদ্ধিটা কারো মাথায় আসে না কেন? কেন আমরা অর্ধশতাব্দী সমান ভাঙনের শোকগাঁথার রাশ টেনে ধরবার কথা ভাবতে পারলাম না? চারলেনের মহাসড়কে, মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, সেতুতে অঢেল টাকা জলের মতো ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্রোতস্বিনী পদ্মার বেপরোয়া জলকে বাগে আনতে কারো মাথায় ব্যথাই জাগল না। তবে যে আমরা যারা রাজনীতিবিদ, যারা নীতিনির্ধারক, যারা উন্নয়ন পরিকল্পক কী জোর গলায় বলে যাই, আমরা সবাই জনসেবক। মানুষের সেবা করাই আমাদের একমাত্র কাজ ও নিরন্তর ধ্যানজ্ঞান। ঘুমের আয়েশকে পাত্তা না দিয়ে জেগে থাকবার পাথর সময়ের একমাত্র আরাধনা হলো সেবা। তাহলে নড়িয়াপাড়ে জলে ভেসে যাওয়া ওঁরা কারা? মানুষ নয়?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে, পদ্মা নদীর ভাঙনে গত ৫১ বছরে হারিয়ে গেছে ২৫৬ বর্গমাইল তথা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ঘরবাড়িসহ যে পরিমাণ জমিজমা পদ্মায় মিশে গেছে তাতে অনায়াসে রাজধানী ঢাকার মতো দুটি শহর প্রবিষ্ট করানো যেত। আমাদের যে পরিমাণ ভূমি আমরা পদ্মাকে খাদ্য হিসেবে দিয়েছি, ৬৯৯ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপরাষ্ট্র সিংগাপুর তার চেয়ে সামান্য বড়। নাসার বিজ্ঞানীরা পদ্মার ভাঙনের দুটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত নদীর ভাঙন ঠেকাতে সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকা এবং দ্বিতীয়ত নদীর তীরবর্তী এলাকায় বালুচর থাকা, যা দ্রুতই ভেঙ্গে যায়। বালুচরকে আমরা রাতারাতি দুআঁশ মাটি বা এটেল মাটিতে পরিবর্তিত করতে পারব না সত্য, আমরা কিন্তু নদীর গতিপথ বদল ঠেকাতে আধুনিক যুগোপযোগী কোনো প্রযুক্তির আশ্রয় নিতে পারতাম।
নদীর ভাঙন নিয়ে গবেষণারত সরকারি ট্রাস্ট সিইজিআইএসের তথ্য মতে, গত ৩৫ বছরে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার ভূমি ও জনবসতি এলাকা নদীগর্ভে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৭ লাখ মানুষ। প্রধান তিন নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ভাঙনেই বিলীন হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর ভূমি। আর বাস্তুচ্যুত মানুষ ১৭ লাখ।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা যদি এখনি ক্রমবর্ধমান এমন ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা না নিতে পারি। তবে স্বল্প ভূমি ও বেশি জনসংখ্যার এই দেশে এই ভাঙন হতে পারে বড় দুশ্চিন্তার নাম। পরিবর্তিত বৈশ্বিক বাস্তবতায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় আমরা যে বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছি তা বদনামে পর্যবশিত হতে পারে। নদীপাড়ের বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে রেখে উন্নয়নের দুর্বার গতির গল্প বিশ্ববাসী বিশ্বাস নাও করতে পারে।
আমরা তো মুখে ধর্মের কথা বলি খুব। তাই যদি হয়, জীবের আত্মারূপে স্রষ্টা জীবের মধ্যে যে অবস্থান করেন, আমাদের সেটাও যথার্থরূপে মানতে হবে বৈকি। আমরা ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের অমর কবিতা ‘দ্য রাইম অব এনশিয়েন্ট মেরিনারে’র শেষের কথাগুলো ভাবনায় রাখতে পারি :
'He prayeth best, who loveth best
All things both great and small;
For the dear God who loveth us
He made and loveth all!'
বেদনার্ত মানুষের আহাজারি আর কোনো দুঃখিনী মায়ের হাহাকারের অভিশাপ থেকে আমাদের কারোরই আসলে মুক্তি নেই। তাই আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বিপর্যস্ত নড়িয়ার মানুষের ডাক পৌঁছাবে শহুরে রাজাধিরাজের অন্দরমহলে। কুম্ভকর্ণ রাজার ঘুম ভাঙবে। সমন্বিত মানুষের সামগ্রিক বিপদকে নিজের বিপদ ভেবে রাজন্যবর্গ কাঁদবেন এবং তা থেকে উত্তরণের পথ বাতলাবেন। তবেই নুতন মাটিতে আসবে ফসলের কাল, আঁধার পেরিয়ে আসবে আগামী সকাল। অন্যথায় ‘সীমানা পেরিয়ে’ মুভির ভূপেন হাজারিকাই পুরো বাঙালির চিরকালীন জীবনসত্য হয়ে থাকবে :
মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই
জল থৈ থৈ করে কিছু নেই নেই
ভাঙনের যে নেই পারাপার
তুমি আমি সব একাকার।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন