চলচ্চিত্রে নিষেধাজ্ঞা
‘জীবন থেকে নেয়া’ ও ‘রানা প্লাজা’
বাংলাদেশের সূর্যসন্তান জহির রায়হান সৃষ্টি করেছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ অনবদ্য চলচ্চিত্র। এটি শুধু চলচ্চিত্র নয়। এটি আজও একটি আন্দোলনের নাম। সমাজের বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠেছিল ছবিটিতে। ফুটে উঠেছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের মুখচ্ছবি। সময়টা ছিল ১৯৭০ সাল।
আজ ২০১৫ সাল। তেমনি একটি বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নিয়ে চলছে দেশব্যাপী আলোচনা। বলছি না এটি ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো মানে-গুণে এক। তা বলার সুযোগও নেই। কারণ এটি এখনো দর্শক দেখার সুযোগ পায়নি। বলছি ‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্রের কথা।
একাধিকবার কোর্টের নিষেধাজ্ঞা, সেন্সর বোর্ডের কর্তন সুপারিশ, সবশেষে আবার তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র অধিশাখা থেকে পাঠানো প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছবিটির মুক্তির বিষয়টি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। ঐ আদেশে বলা হয়, ‘সিভিল রিভিউ পিটিশন নং ১৯১/২০১৫ শুনানিকালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের আলোকে ফিল্ম সেন্সর আপিল কমিটি কর্তৃক রানা প্লাজা নামক চলচ্চিত্রের আপিল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যস্ত সেন্সর সার্টিফিকেট সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো এবং ‘রানা প্লাজা’ নামক চলচ্চিত্র সমগ্র বাংলাদেশে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো।’
সেন্সর বোর্ড প্রথমেই ছবিটির মুক্তির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। পরে ছবিটির প্রযোজক হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট কয়েকটি স্থানে দৃশ্যকর্তন ও নাম পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে মুক্তির পক্ষে রায় দেন। পরিচালক তা কর্তনও করেন। তবে সেন্সর বোর্ড ফের আপত্তি তোলে পরিচালক যথাযথভাবে ছবির দৃশ্য কর্তন করেননি।
প্রযোজক সেন্সর বোর্ডের বিরুদ্ধে আদালতে যান, আদালত আবারও পক্ষে রায় দেন। এ রায় ছিল জুলাই মাসে। ছবিটি বর্তমান মাসে দেখানোর কথা ছিল, এর আগেই আবার ঘটল বিপত্তি। ছবিটি প্রদর্শন বন্ধ করতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বাদী হয়ে রিট দায়ের করেন। রিট আবেদনে বলা হয়, ‘রানা প্লাজা নিয়ে নির্মিত ছবিতে দেশের পোশাকশিল্পের বিষয়ে খারাপ মনোভাব তুলে ধরা হয়েছে। এ ছবি প্রদর্শিত হলে বিদেশে আমাদের পোশাক খাত আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তাঁর এ বক্তব্য যৌক্তিক মনে করেননি বলেই প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রিট আবেদন খারিজ করে দেন।
রায় শেষে দেশবাসীর যখন ছবিটি দেখার ক্ষেত্রে আর কোনো বাঁধা ছিল না, তখনই তথ্য মন্ত্রণালয়ের এ স্থগিতাদেশ।
কোনো সত্য তথ্য তুলে ধরলে যদি ক্ষতি হয়, তাহলে ওই ক্ষতির কথা চিন্তা করা ঠিক না। দেখার বিষয় আমাদের পোশাকশিল্প তাদের মান কতটুকু উন্নত করতে পেরেছে। তাদের দুর্বলতাগুলো তারা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কি না। তারা কতটুকু শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ ও মাইনে নিশ্চিত করতে পেরেছে। নাকি এখনো রানা প্লাজা বা তাজরিন ফ্যাশনসের মতো পরিবেশ আছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনার জন্য কিন্তু জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক থেমে থাকেনি। চলছে। অতীতকে আঁকড়ে নয়, শিক্ষা নিয়েই চলতে হয়।
বিদেশি কোনো পরিচালক যদি বিদেশের মাটিতে ঠিক এই ঘটনাট বা তাজরিন ফ্যাশনস নিয়ে ছবি বানায় তাহলে তা কি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছুতে বেগ পেতে হবে? মোটেই না।
ছবিটির পরিচালক নজরুল ইসলাম খানের ভাষ্য মতে, সাভারের রানাপ্লাজার ধস আর ১৭ দিন পর উদ্ধার হওয়া রেশমা চরিত্রকে ঘিরেই এটি নির্মিত হয়েছে।
‘জীবন থেকে নেয়া’তে রূপকভাবে ফুটে ওঠেছিল তৎকালীন বাঙালি জনসাধারণনের আন্দোলনের কথা। আমরা ছবিটির দৃশ্যের পাশাপাশি গানগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখলেই বুঝতে পারছি। ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’, আর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
তৎকালীন সেন্সর বোর্ড রাষ্ট্রপক্ষের মতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ছবিটি মুক্তি দিতে চায়নি। তারা ছবিটির সত্য মেনে নিতে পারেনি। কারণ তারা ঠিকই অনুভব করতে পেরেছিল এটা অন্য ১০টি ছবির মতো প্রাণ ধারণ করে না। এ ছবির প্রাণ অমর। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর তা বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মনে ভুলে যাওয়া অতীতের দুঃখ-কষ্টের সামগ্রিক পুনঃপ্রকাশ ঘটাবে।
হয়ত রানা প্লাজার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপক্ষের সেই চিন্তা। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ঘটে যাওয়া এ হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকাময় দৃশ্য মানুষ আবার মনে করবে। মানুষ আবার মনে করবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘নাড়ানাড়ি’ তত্ত্বের কথা। মানুষ আবার আলোচনায় নিয়ে আসবে বিতর্কিত রেশমা উদ্ধারের কথা। মানুষ আবার চ্যালেঞ্জ করবে রাষ্ট্রপক্ষের দেওয়া এক হাজার ১৩৪টি লাশের হিসাব। তারা বলবে এখনো টোকাইরা খুঁজে পাচ্ছে মানুষের কঙ্কাল। মানুষ আবার ফুঁসে উঠবে রানাদের মতো ঘাতকদের বিরুদ্ধে। সামগ্রিকভাবে আবারও জনরোষের মুখে পড়বে মুনাফাখোরি মালিকশ্রেণি। সাথে বাদ যাবে না তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতারাও।
আমি জানি না নির্মাতা ছবির ভিতরে কতটুকু প্রাণ জন্ম দিতে পেরেছেন, সেই দুর্ঘটনার কতটুকুই বা ফুটে উঠেছে কুশীলবদের অভিনয়ে।
ব্যক্তিগতভাবে প্রথম চারদিন উদ্ধার তৎপরতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। এতটুকু মনে আছে দুই থেকে তিন মাস বহুতল ভবনে গেলে আৎকে ওঠতাম। মনের অজান্তেই স্নায়ু দুর্বল হয়ে যেত। যদি ভুল না করি রানা প্লাজার ভবনটি যে একটি ডোবার মধ্যে তড়িঘড়ি করে অপরিকল্পিতভাবে, দখল করার মানসিকতায় নির্মাণ করা হয়েছিল এই সংবাদ আমিই প্রথম ‘দৈনিক সংবাদ’-এ করেছিলাম। তথ্যের কারচুপি হলে ক্ষমাপ্রার্থী। এখনো অতি মুনাফাখোরি মালিকশ্রেণির প্রতি মনের অজান্তেই ঘৃণা চলে আসে।
এতটুকু বলতে পারি ছবিটি মুক্তি পেলে আমি একবারের জন্য হলেও ছবিটি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে দেখতে যাব। আর ভবনটিতে থাকা হাজার হাজার শ্রমিকের পরিবারের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি জানি, সরকার আজ হোক কাল হোক এ ছবির ওপর হতে স্থগিতাদেশ না উঠিয়ে পারবে না। এটা আমার বিশ্বাস। তবে এটা সত্য সাম্প্রতিক সময়ে কোনো বাংলা ছবি মানুষের মধ্যে এত আলোচনার বস্তু হতে পারেনি। যতটা পেরেছে এটি। এ আলোচনা প্রসারের সর্বশেষ জোগান দিল স্বয়ং রাষ্ট্রপক্ষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ থাকবে ‘আপনি যা সঠিক তাই করুন’। যদি মনে করেন এটি মিথ্যার প্রসার ঘটাবে তাহলে স্থগিতাদেশ বজায় রাখুন। এর বিপরীত হলে তা অভিভাবক সুলভ আচরণ হবে না।
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির মুক্তির জন্য এক ধরণের জন আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। মানুষ মাঠে নামতে বসেছিল। মুক্তি চাই মুক্তি চাই ‘জীবন থেকে নেয়া’র মুক্তি চাই। নিশ্চয় সবাই জানেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী, মেজর মালেক ও তাদের এ দেশীয় দোসররা সেন্সর পর্যায়েও এ সিনেমার ছাড়পত্র না দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হন। এর আগে তো জহির রায়হানসহ অনেককে শুটিং স্পট থেকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক রাখার কথা প্রচলিত রয়েছে।
তাঁদের আবিষ্কার ছিল, রওশন জামিলের চরিত্রটি একটি স্বৈরাচারের চরিত্র। যা আইয়ুব খানকে ইঙ্গিত করে। তাই এটি একটি সরকারবিরোধী ছবি।
জানিনা ‘রানা প্লাজা’য় সেই বিমর্ষ মানুষের আর্তনাদ আর লাশের মিছিল কি সেই আইয়ুব সুর বহন করে কি না?
জহির রায়হান থেমে যাননি। পুনরায় আবেদন করেন। এবার বোর্ডে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে জনবিক্ষোভ শুরু হলো। পরের দিন আর কি করার, সেন্সর বোর্ড পুনরায় ছবিটি দেখলেন। ছবি দেখা শেষে রাও ফরমান নাট্যকার আসকার ইবনে সাইককে মন্তব্য করতে বলেছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন ‘স্যার পবিত্র কোরআনে কোনো মিথ্যে কথা বলা নেই। মিথ্যে কথা বলবার কোনো সুযোগও সেখানে দেওয়া হয়নি। জহির হয়তো ভুল করে একটা সত্য সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে। এই সত্যকে আমি কীভাবে মিথ্যা বলি!’ কেউ আর কোনো কথা বলল না। ছবিটি মুক্তি পেল।
তবে রাও ফরমান জহির রায়হানকে ভবিষ্যতে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এ হুমকি হুমকিই রয়ে গেল। মাঝখানে ‘জীবন থেকে নেয়া’র জীবন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ল লাখো-কোটি জনতার অস্থিমজ্জায়। এখনো তা অবিচল আছে। সামনের দিনগুলোতেও থাকবে।
এখানেও লাগবে আসকার ইবনে সাইকের মতো লোকদের। হয়তো এই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে পারেন আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মতো সরকারের কাছের ব্যক্তিত্বরা।
আর তাঁদের কাছে পৌঁছুতে লাগবে আমজাদ হোসেনের মতো লোকদের। তিনিই মাধ্যম হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন সাইককে। ‘জীবন থেকে নেয়া’র মুক্তির জন্য পা টিপে টিপে বলেছিলেন জনআগ্রহ ও জনক্ষোভের কথা।
মাটির ময়নাও নিষিদ্ধ ছিল। লাভ হয়নি। দেশি-বিদেশি কত পুরস্কারই না ছবিটি নিজ ঝুলিতে পুরল। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে হরহামেশাই হচ্ছে নানা প্রশ্ন।
আজকে আমরা ‘গেরিলা’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ-এর মতো ছবি নির্দ্বিধায় দেখছি। প্রশংসা প্রকাশ করছি। কিন্তু মৌলবাদী কোনো সরকার যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে এসব ছবিও হয় তো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তখন আমরা কী বলব? হুমায়ূন আজাদ বা তসলিমা নাসরিনের লেখাও নিষিদ্ধ ছিল বা আছে। তা বলে কি পাঠকের কাছে তা পৌঁছেনি। কোন ফাঁকে বা কোন পদ্ধতিতে এই ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে তা ভেবেও কূল পাওয়া যাবে না। হয়তো একদিন সংবাদ আসবে মোবাইলে ফোনে ছড়িয়ে পড়েছে ‘রানা প্লাজা’।
দেশি-বিদেশি মিডিয়া ইতিমধ্যে ‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্রের বিষয়টি বেশ আলোচনায় নিয়ে এসেছে। মুক্তির ক্ষেত্রে যতই গড়িমসি হচ্ছে মানুষের মধ্যে ততই আগ্রহ ও কৌতুহলের জন্ম নিচ্ছে। আমার মনে হয় ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর অন্তত প্রথম সপ্তায় সিনেমাহলগুলোয় লোকজনের বেশ উপস্থিতি ঘটবে। পাইরেসি করা প্রিন্ট দিয়েই ঘটবে ‘ইউটিউব’ ঝড়। পকেটের পেনড্রাইভগুলো এই কম্পিউটার থেকে ওই কম্পিউটারে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাবে। ‘ব্লু-টুথ’ আর ‘শেয়ারইট’এর মতো ডিভাইসগুলো মোবাইল দর্শকদের দেবে স্বস্তি ।