স্মরণ
আতাউস সামাদ ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিক

একজন আতাউস সামাদ, যাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল সংবাদমাধ্যম। কখনো কলমে, কখনো কণ্ঠে লড়ে গেছেন দেশ ও মানুষের জন্য। কিন্তু তাঁকে কি মনে রেখেছি আমরা?
দেখতে দেখতে ছয় বছর পেরিয়ে গেল, ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে তিনি মারা যান। কিন্তু কোনো পত্রিকায় বিশিষ্ট এই সাংবাদিক স্মরণে এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। অথচ কি বৃহৎ এখন আমাদের গণমাধ্যমের কলেবর, কতশত পত্রিকা, অনলাইন, সংবাদ সংস্থা, অনলাইন, টিভি, ডজন ডজন বেসরকারি রেডিও, টিভি চ্যানেল, কত বৃহৎ পরিসর তাই না? কিন্তু তিনি যেন কখনো ছিলেন না আমাদের মাঝে।
শুধু আতাউস সামাদ হবে কেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার স্মরণীয়-বরণীয়, জ্ঞাণী-গুণী কাকেই বা আমরা স্মরণ করি, মনে রাখি? আমরা কি তবে একটি বিবর্ণ নতুন প্রজন্ম রেখে যাচ্ছি? এমন প্রশ্নের কতটা দায় এড়াতে পারবে আজকের মূলধারার গণমাধ্যম?
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে গোটা বাংলাদেশ যখন স্বৈরাচারের আতঙ্কে আতঙ্কিত ছিল, তখন বিবিসি থেকে রাষ্ট্রের কথা উঠে আসত তাঁর কণ্ঠে। মিডিয়ার সংখ্যা কম থাকায় তখন মানুষ দেশের খবরাখবর জানতে রেডিওতে কান পেতে থাকত। প্রথিতযশা এই সাংবাদিকের দরাজ কণ্ঠ এখনো যেন কানে বাজে অনেকের। জেনারেল এইচ এম এরশাদের সেই সামরিক শাসনের সময় তাঁর সাহসী সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। বিবিসিতে নির্ভীক প্রতিবেদনের জন্য সামরিক সরকারের আমলে কারাবরণ করেন এই সাংবাদিক।
প্রবীণ এই সাংবাদিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন। বঙ্গবন্ধু যে কজন সাংবাদিককে ভালোবাসতেন, সামাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে নয়াদিল্লিতে বাসসের বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব দেন।
ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক পরিচয় রয়েছে এই অগ্রগণ্য সাংবাদিকের। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ছিলেন আতাউস সামাদের ভগ্নিপতি। তাঁর বাবা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আবদুস সামাদ ও মা সায়েরা বানু। আতাউস সামাদের ভাই আতিকুস সামাদ বিবিসি লন্ডনে সাংবাদিকতা করেছেন।
তাঁর স্ত্রী কামরুন্নাহার রেনু দীর্ঘদিন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) কর্মরত ছিলেন। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
আতাউস সামাদ দীর্ঘ সময়, অর্থাৎ ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। পরে কিছুকাল বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বও পালন করেন। নামকরা কলামিস্ট ছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রায় সব ধরনের গণআন্দোলনে লেখনীর মাধ্যমে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন আতাউস সামাদ। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন।
১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তাঁর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সতেরদরিয়ায়। এ গ্রামে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর।
খ্যাতিমান সাংবাদিক আতাউস সামাদ তাঁর কর্মবহুল সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন ঢাকায় ১৯৫৯ সালে। সত্তরের দশকে দ্য সান পত্রিকার পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) সংবাদদাতা ছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি নামী-দামি সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতা করেন খ্যাতিমান এই সাংবাদিক। তাঁর শেষ কর্মস্থল দৈনিক আমার দেশ, তিনি পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন, একই সঙ্গে তিনি ‘সাপ্তাহিক এখন’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নিউজের বাংলাদেশস্থ সংবাদদাতা (১৯৮২-৯৪), নয়াদিল্লিতে বাসসের বিশেষ সংবাদদাতা (১৯৭২-৭৬), পাকিস্তান অবজারভার (অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ অবজারভার) পত্রিকার চিফ রিপোর্টার (১৯৬৫-৬৯) ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন (ইপিইউজে, ১৯৬৯, ১৯৭০) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সামগ্রিকভাবে আমাদের গণমাধ্যম এখন অনেক এগিয়ে, অনেক বেশি সচেতন আর দায়িত্বশীল। তারপরও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক-প্রকাশক, সাংবাদিক বা গণমাধ্যমে যাঁরা চালকের আসনে আছেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, সাংবাদিকতায় যাঁরা পথিকৃৎ, তাঁদের যেন আরো বেশি করে স্মরণ করি।
লেখক : ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ