অর্থনীতি
ছাগল কোরবানি ও এর আর্থসামাজিক উপযোগিতা

আমাদের দেশে ছাগল পালন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে একটি বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। বাংলাদেশের কালো জাতের ছাগল পৃথিবী বিখ্যাত। এ ছাগলের মাংস, চামড়া, লোমসহ প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। কাজেই কোরবানির জন্য এবং তৎপরবর্তী আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ জাতের ছাগলের কোনো তুলনা হয় না। ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট যার বাংলা অনুবাদ করলে নাম দাঁড়ায়- বাংলার কালো ছাগল। বৈজ্ঞানিক নাম হলো- capra aegagrus hircus.. বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু উন্নত মানের ছাগলের জাতের নাম হলো- ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল (black bengal goat)বারবারি ছাগল (barbari goat), বিটাল ছাগল (Beetal goat), বোয়ের ছাগল ( Boer goat), যমুনা পাড়ি (jamnapari goat), কিকু ছাগল (kiko goat), স্পেনিশ ছাগল (Spnais goat), সাহেলিয়ান ছাগল ( Sahelian goat) ইত্যাদি প্রধান।
প্রতিবছর ঈদুল আজহায় মুসলমানদের ধর্মীয় ত্যাগ হিসেবে পশু কোরবানি করা হয়ে থাকে। সেখানে যে যার যার সঙ্গতি অনুযায়ী পশু কোরবানি করে থাকেন। ইসলামী বিধান মতে চতুষ্পদী ও হালাল পশুকে কোরবানি করতে হয়। তদানুযায়ী গরু, মহিষ, উট, দুম্বা, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশুকে কোরবানির জন্য নির্বাচন করা হয়ে থাকে। দুম্বা এবং উট আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। এগুলো মূলত মরুভূমিতে পালিত পশু। উটকে আবার মরুভূমির জাহাজও বলা হয়ে থাকে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ পশুকে বেশিমাত্রায় দেখা যায়। সে কারণে হজব্রত পালন করতে গেলে সেখানেও হজের রীতির মধ্যেই হাজিরা কোরবানির অংশ হিসেবে দুম্বা কিংবা উট অথবা ভেড়া কোরবানি করে থাকেন। আর তাই অনেক সময় উট দেখতে হলে আমাদের দেশের চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখতে হয়। কোনো কোনো সময় সৌখিন কিছু ক্রেতা-বিক্রেতা কোরবানির উদ্দেশে আমাদের দেশে ঈদের আগে বাজারে দুয়েকটি উট নিয়ে আসতে দেখা যায়। অন্যথায় হর-হামেশা গরু, মহিষ ও ছাগল কোরবানি করা হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে ছাগল ছোট চতুষ্পদী পশুর মধ্যে কোরবানির জন্য খুবই উপযোগী। আর ছাগলের মধ্যে তো অবশ্যই সেটা বাঙালির অতিপরিচিত ও সবার কাছে সহজলভ্য ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এ ছাগল শুধু বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
আমরা চলার পথে রাস্তার ধারে কালো রঙের যে ছাগল দেখতে পাই, তাই আসলে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট। কেন ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটই সেরা সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করছি। ইসলামী বিধান মতে কোরবানির পশু হওয়া চাই সুস্থ, সবল, নিরোগ, সতেজ, বিকলাঙ্গমুক্ত, নিখুঁত ইত্যাদি ধরনের। আর সেজন্য কোরবানির পশু হিসেবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জুড়ি নেই। এ জাতের ছাগলটি দেখতে খুবই সুন্দর, তেল-তেলে এবং গাঢ় কালো রঙের লোমসমৃদ্ধ বহিরাংশ। যে কেউ যেকোনো স্থানে অতি সহজেই এ জাতের ছাগল অনায়াসেই প্রতিপালন করতে পারে। কথায় আছে, ‘ছাগলে কি না খায় ...’। অর্থাৎ ছাগলে সবকিছুই খায়, তাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে হয় না। এটি বছরে দুবার বাচ্চা দেয় এবং প্রতিবারে ৩-৪টি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এখানেও আরেকটি কথা প্রচলিত আছে, ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ অর্থাৎ ছাগলের স্তন্যে একসাথে দুটির বেশি বাচ্চা দুগ্ধ পান করতে পারে না। সেজন্য বাচ্চা তিনটি হলে প্রথমে দুটিতে পান করে, তৃতীয়টি তখন লাফাতে থাকে দৃগ্ধপানের জন্য, আবার চারটি হলে প্রথমে দুটি পরে আরো দুটি; এভাবে প্রাকৃতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এরা বড় হতে থাকে। অপরদিকে ২০ কেজি ওজনের একটি ছাগল হতে প্রায় ১১ কেজি ওজনের মাংস পাওয়া যায় যা মোট ওজনের প্রায় ৫৫% এর বেশি। অতি অল্পদিনের মধ্যেই একেকটি ছাগল মাংসল ও বিক্রি উপযোগী হয়ে যায়। পুরুষ ছাগল ইসলামী বিধান মতে খাসি (Castration) করা হলে তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় এবং মাংসও ভালো হয়। খাসি না করলে পাঁঠা হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকে।
গরুকে মোটাতাজাকরণের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক প্রয়োগের মতো করে ক্ষতিকর বিষপ্রয়োগের অংশ হিসেবে ছাগলকেও সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আসা ক্ষতিকর স্টেরয়েড বা পামজাতীয় বড়ি খাওয়ানোর দরকার নেই। কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অতি সহজেই দেশীয় খাবার খাইয়েই ৪-৫ মাসে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলকে মোটাতাজা করে মাংসের বাজারে তোলা সম্ভব। এক কোরবানি ঈদের পরে জন্ম নেওয়া কোনো ছাগলের বাচ্চাকে ভালোভাবে যত্নসহকারে দেশীয়ভাবে প্রতিপালন করলে পরের বছরের কোরবানি ঈদেই সেই ছাগলটি কোরবানি করার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। ছাগল থেকে পাওয়া যায় উন্নত মানের চামড়া যা পৃথিবীর অন্য যেকোনো জাতের ছাগলের চামড়া থেকে গুণতগমানসম্পন্ন। খাসির মাংস খেতে খুবই সুস্বাদু। ছাগলের লোম থেকে তৈরি হয় উন্নতমানের পশম। এ ছাগলের দুধ হলো অনেক রোগের মহৌষধ। এখনো গ্রামের ধাত্রীবিদ্যায় অভিজ্ঞ নারীরা সন্তানসম্ভবা মায়েদের এবং ভূমিষ্ঠ হলে বাচ্চাদের ছাগলের দুধ পানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদিও কালের ব্যবধানে তাঁদের অনেক পরামর্শই এখন আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সমর্থন করে না, কিন্তু ছাগলের দুধ পান করানোর পরামর্শটি মোটেও অমূলক নয়।
ছাগল পালন গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। মহিলা ছাগলকে বকরি বলা হয়। কোনো বাড়িতে যদি অন্তত একটি বকরি থাকে, আর সেটা যদি ভালোভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রতিপালিত হয়ে থাকে, তাহলে এ থেকেই বছরে দু-দুবার কমপক্ষে ৪-৮টি বাচ্চা পেয়ে সেই পরিবারের বাড়তি আয় হয়। সেই পরিবারের দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে এ রকম ৪-৫টি ছাগলই যথেষ্ট। অথচ এ ছাগল পালনের জন্য বাড়তি কোনো খরচের প্রয়োজন পড়ে না। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা হতে প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে এ জাতের ছাগল প্রতিপালনের জন্য উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষত মহিলাদের দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও অবসর সময় কাটানোর জন্য ছাগল পালনের কোনো বিকল্প নেই। এটি এখন অন্যতম আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
দেশে প্রতিবছর শুধু কোরবানির ঈদেই প্রায় ৪০ লাখ ছাগলের চাহিদা রয়েছে। এত সংখ্যক ছাগল পালন করতে গিয়ে সারাদেশে প্রায় ৪০ লক্ষ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। সেখানে কোরবানি করা পশুর চামড়ার পুরো মূল্যই হলো গরিবের হক। কাজেই সে সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য পেয়ে তাদের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। প্রায়ই দেখা যায়, কোরবানি করার ক্ষেত্রে আমরা বাঙালিরা প্রতিটি শক্ত সামর্থ গরুতে সাতটি পর্যন্ত নামে/ভাগে শরিক হওয়ার নিয়ম মেনে চলি। কিন্তু ঈদের সময় কর্মজীবী মানুষজন তাদের কাজের চাপে কিংবা সমমনা সাতজন মিলানোর অভাবে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও গরিবের হক আদায়ের তাগিদে পবিত্র কোরবানি করার হিতাহিত ভেবে পায় না। অপরদিকে অনেকে কোরবানি করার ইচ্ছাপোষণ করলেও সঙ্গতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। সেসব ক্ষেত্রে একক নামে/ভাগে শরিক হিসেবে কোরবানির পশু নির্বাচনে আমাদের দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল হতে পারে তাদের পছন্দনীয় পশু। অনেকে গ্রামের বাড়িতে তাদের নিজেদের কোরবানির জন্য নিজেরাই এ জাতের ছাগল প্রতিপালন করে থাকে। কেউ কেউ আবার তাদের সঙ্গতি অনুযায়ী একাধিক পশুকে কোরবানির তালিকায় রাখে, সেখানে তাদের পছন্দের তালিকায় অবশ্যই এ জাতের ছাগল রেখে থাকে। শুধু কোরবানি ঈদের দিনে সারা দেশে যে পরিমাণ পশু কোরবানির উদ্দেশে জবাই হয়ে থাকে; সারা বছরেও এর পরিমাণ তার ধারেকাছে যেতে পারে না। সেজন্য কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এ জাতের ছাগল প্রতিপালন করে সারা দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হয়ে থাকে।
এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের আমাদের এ ছাগল খুবই রোগ প্রতিরোধী এবং সহজে রোগবালাই হয় না, আর হলেও এর চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ ধরনের। নিকটস্থ পশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেই এর সুচিকিৎসা পাওয়া যায়। আসন্ন কোরবানি ঈদে ছাগলসহ সব ধরনের পশুর অবাধ চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত যানবাহন, বৈধ বাজার এবং চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশ বজায় রেখে অন্যান্য পশুর সাথে ছাগলকেও যাতে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট আমাদের জাতীয় ও গর্বের সম্পদ।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।