ক্রিকেট
বিরাট নামের পাশে মুমিনুল
‘মুমিনুলিজম’— শব্দটা বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে কী আদৌ পরিচিত! খুব জোর দিয়ে বলা যায়, শব্দটা প্রায় অপরিচিত। কিন্তু যদি শব্দটা হয় শুধু মুমিনুল; তাহলে লাখ কণ্ঠে সমস্বরে উচ্চারিত হবে; আরে সে তো আমাদের মুমিনুল! যাকে একসময় বলা হচ্ছিল বাঙালির ব্র্যাডম্যান! টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডনের পর গড় রেখে রান করে যাচ্ছিলেন। ম্যাচের পর ম্যাচ ষাটের ওপরে গড় রেখে রান করে যাচ্ছিলেন! হঠাৎ করে সেই লোকটা বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে প্রায় ফেড আউট হয়ে গেলেন! বছরে একটা-দুটো টেস্ট ম্যাচ হলে তাঁর ডাক পড়ে। আর তাঁর গায়ে এঁটে দেওয়া হলো ‘টেস্ট ক্রিকেটার’র তকমা! এর পর থেকে তাঁর গড়টা ক্রমশ নিম্নমুখী হতে শুরু করল। যার গড় ছিল পঁয়ষট্টির ওপরে, সেটা নেমে এলো পঞ্চাশের নিচে! এবং সেটা চান্দিকা হাথুরুসিংহের জমানায়!
হাথুরু তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে একের ভেতর অধিক। কোচ। নির্বাচক। এককথায় সবই। প্রায় ডিক্টেটরের মতো তিনি চালিয়েছেন বাংলাদেশ। দলের ক্রিকেটারদের ব্যাপারে তাঁর লাইকিং-ডিসলাইকিং ছিল প্রবল। কিন্তু তাঁর সময়ে দল সাফল্য পেয়েছে। তাই এসব নিয়ে কারো কোনো ভাবনা-চিন্তা করার সময় ছিল না। মুমিনুল কেন রান পাচ্ছেন না! তাঁর সামর্থ্য-যোগ্যতা-দক্ষতার বিকাশ কেন থেমে গেল, সেসব প্রশ্ন অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল!
কিন্তু হাথুরুসিংহের জমানা শেষ হতেই আবার স্বমূর্তিতে মুমিনুল! টেস্ট ক্রিকেটে আবার এই বাঁহাতি বাংলাদেশের রানমেশিন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ বাঁচানো শেষ টেস্টে বড় সেঞ্চুরি। তারপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি। টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে তাঁর নামের পাশে চারটা টেস্ট সেঞ্চুরি! আর এই চার সেঞ্চুরি তাঁর নামটাকে বসিয়ে দিল বিরাট কোহলির মতো মর্যাদাব্যঞ্জক এক নামের পাশে। কিন্তু তাতেই খানিকটা বিব্রত মুমিনুল। একই সঙ্গে আরো বেশি বিনয়ী। যে কারণে তিনি বলতে পারেন, ‘কোহলি ক্রিকেটবিশ্বে অনেক বড় নাম। অনেক বড় ব্যাটসম্যান।’ মুমিনুলের এই বাক্যটা নতুন এক উপলব্ধির কথা মনে করিয়ে দিল। সম্মান গ্রহণের চেয়ে তাঁর কাছে সম্মান প্রদান অনেক বেশি জরুরি। তাই এক জায়গায় বিরাট কোহলির সমান সম্মান অর্জনের পরও তাঁর সঙ্গে তুলনায় তিনি বিব্রত! এটাই হচ্ছে মুমিনুলিজমের প্রাককথনের ভিত।
তাহলে মুমিনুলিজম বলতে ঠিক কী বোঝায়? উত্তর খুব কঠিন কিছু তাও নয়। খুব সহজ। নিষ্ঠা। একমুখিতা। প্রতিজ্ঞা। প্রতিভা। পরিশ্রম। আর সততা। এসব কিছুর মিশেলেই একজন মুমিনুল হক। মুমিনুল জানতেন হাথুরু এক ব্যক্তি, যার পছন্দ-অপছন্দ খুব প্রবল। তবে তাঁর সেই পছন্দ-অপছন্দের প্রাবল্যে তিনি ভেসে যাননি। নিজেকে হারিয়ে যেতে দেননি। নিজের নিষ্ঠা, একমুখিতা, প্রতিজ্ঞা, পরিশ্রম আর সততার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনো তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু হতাশা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। ফিরে আসার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে আবার ফিরেছেন নেটে। ফেরার দৌড়ে। তিনি ফিরেছেন। কিন্তু সেটা কোনো একজন হাথুরুসিংহের সামনে কিছু প্রমাণের জন্য নয়। বরং নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ দেওয়ার জন্য।
মুমিনুল ছোটখাটো এক গড়নের বাঁহাতি এক ব্যাটসম্যান। কিন্তু তাঁর মনের জোর অনেক। যে কারণে বারবার ফিরে এসে বড় ইনিংস খেলতে পারেন। ‘মানসিকভাবে ও দারুণ শক্ত। ওকে কাছ থেকে দেখেছি বিপিএলে।’ ক্রিকেট আড্ডায় একদিন বলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ সারোয়ার ইমরান। অস্বাভাবিক মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে মাঝেমধ্যে শুধু টেস্ট খেলে ওভাবে বড় ইনিংস খেলার অভ্যাস বজায়ে রাখা যায়! টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির যৌথমালিক মুমিনুল আর তামিম ইকবাল। দুজনেরই আটটা করে সেঞ্চুরি। তবে তামিমের যেখানে আটটা সেঞ্চুরি করতে খেলতে হয়েছে ৫৬ টেস্ট। মুমিনুল খেলেছেন সেখানে ৩২ টেস্ট। এই তুলনা কারো যোগ্যতাকে খাটো বা বড় করার জন্য নয়। কিন্তু ক্রিকেট যতই মনস্তাত্ত্বিক খেলা হোক, তার প্রতিফলন সংখ্যায়। ক্রিকেটে সাফল্য-ব্যর্থতা-যোগ্যতা-অযোগ্যতা সবকিছুই মাপা হয় সংখ্যা দিয়ে।
সংখ্যার বিচারে হাথুরুসিংহের জমানা বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক সাফল্য। কিন্তু তাঁর কোচিংয়ে মুমিনুল কেন সেভাবে সফল হতে পারলেন না! এটা বড় এক রহস্য হয়ে থাকবে। উত্তরটা দিতে পারেন দুজন ব্যক্তি। একজন মুমিনুল। কিন্তু তিনি ব্যাট হাতে যত সাবলীল, মুখে ঠিক ততটাই আড়ষ্ট। অন্তর্মুখী। তাঁর কাছ থেকে আপাতত কোনো উত্তর পাওয়ার আশা না করাই ভালো। আরেকজন হাথুরুসিংহে। যিনি নিজের দেশ শ্রীলংকার কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের সাফল্য আরব সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে! দ্বীপ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংকট যেমন প্রকট হয়ে উঠেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলছে তাদের ক্রিকেটীয় সংকট। হাথুরুসিংহের শ্রীলংকা নিজের মাঠেও নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। তারপরও বাংলাদেশ ক্রিকেটে হাথুরুসিংহের সময় পাওয়া সাফল্যকে তো অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোচ হিসেবে হাথুরুর একটা গরিমা আছে। থাকবে। তিনি অনেক কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যুবনীতিকে উন্নতির পথ হিসেবে খুঁজেছেন। দ্বিস্তর নির্বাচক কমিটি করে নিজের কথাটাই শেষ কথা বানিয়েছেন। কিন্তু মুমিনুল কেন তাঁর সময় সেভাবে সাফল্য পেলেন না? এই প্রশ্নে তিনি বিরক্ত হতে পারেন। হলেও কিছু করার নেই। কারণ, তিনি যখন জাতীয় দলের দায়িত্ব ছিলেন, তখন শুধু সিরিজ বাই সিরিজই কোচিং করিয়েছেন। যাঁরা ব্যর্থ হচ্ছিলেন। যাঁরা বিপন্নবোধ করছিলেন। তাঁদের সেই বিপন্নতা কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি আলাদাভাবে কারো সঙ্গে বৈঠক করেছেন, নেটে নেমে পড়েছেন তাঁদের নিয়ে, নতুন কোনো অনুশীলন করিয়েছেন এমন কোনো উদাহরণ জানা নেই দেশজ ক্রিকেট প্রেসেরও।
হাথুরুসিংহ চলে যাওয়ার পর মুমিনুলের চারটা সেঞ্চুরি! তাহলে কি হাথুরুসিংহের সঙ্গে মুমিনুলের যোগাযোগের কোনো অভাব ছিল? নাকি এই প্রশ্নকে পাশে সারিয়ে রেখে বলতে হবে; মুমিনুল রান পাচ্ছেন তার একটাই কারণ— মুমিনুলিজম। তাঁর প্রতিভা, পরিশ্রম, প্রতিজ্ঞা, একমুখিতা নিয়ে এখন দলের ভেতরেও কারো কোনো সন্দেহ নেই। মুমিনুল বাংলাদেশ ব্যাটিং অর্ডারে এখনো অস্তমিত কোনো শক্তি নয়।
তবে হ্যাঁ, মুমিনুলকেও প্রমাণ করতে হবে সব মাঠ চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম নয়। আট টেস্ট সেঞ্চুরির ছয়টি এসেছে তাঁর এখান থেকেই। ক্রিকেট গ্রহের বাকি ভেন্যুগুলোতে আলো ছড়ানোর দায়িত্বও মুমিনুলের। তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সেরা ফ্রেমগুলো শুধু চট্টগ্রামের সাগরিকায় বন্দি থাকবে, তা কী করে হয় মুমিনুল!
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।