ভোট উৎসবে প্রতিষ্ঠা পাক গণতন্ত্র
নানা জল্পনাকল্পনা, বাদানুবাদ ও গালভরা প্রতিশ্রুতির পর অবশেষে এলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। সবার সমান অংশগ্রহণে আজ উৎসব হবে? মানুষের ভোটের অধিকার সমুন্নত থাকবে? সাধারণ মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করে সংসদে সমাসীন করতে পারবে? সব প্রশ্নের উত্তর আজ দিন শেষেই মিলে যাবে। তার আগে আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, ভোটের উৎসবটা যেন দেশের গণতন্ত্রের পালে নতুন হাওয়া দেয়। পক্ষে-বিপক্ষের সকল মানুষের মনে যেন শান্তি ফেরে।
মানুষের ভোটে যারা নতুন সরকার গঠন করবে, তাদের প্রতি আপামর জনসাধারণের অভিযোগের বোঝাটা এবার যেন কমে। মানুষ যেন গলা খুলে তার মনের কথা বলতে পারে। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যদি মানবীয় বোধের উন্নয়ন না হয়, তবে আর্থিক অগ্রগতির এক কানাকড়ি দাম নেই। নৈতিকমানে যদি আমরা সভ্য দেশের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারি, তবে বিলিয়ন ডলারের প্রবৃদ্ধি মূল্যহীনই থেকে যাবে।
এবারের ভোটও যথারীতি দুভাবে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ বলছে, সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে তারাই বেশিরভাগ জনগণের ভোট প্রাপ্য। প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের মতে, শেখ হাসিনা আশা করছেন, ১০ কোটি ভোটার সহিংসতাকে ঘৃণা করে দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে গুরুত্ব দেবেন। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়ে যাওয়া ও গত এক দশকে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হওয়ার বিষয় রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগই এসেছে দেশের ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের গার্মেন্ট খাত থেকে, যেখানে ৪৫ লাখ মানুষ কাজ করেন। এ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ দ্বিগুণ বেড়েছে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের সুবিধা বাড়ায় গড় আয়ু ৭২ বছর হয়েছে, যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি।
অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের জোট ঐক্যফ্রন্টের দাবি, দেশে গণতন্ত্রের কোনো লেশমাত্র নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণতার জন্য মানুষ কথা বলতে পারে না। রাজনৈতিক মতদ্বৈধতার কারণে গ্রেপ্তার হচ্ছে হাজারো মানুষ। কাজেই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য তাদের ধানের শীষ প্রতীকই ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার একমাত্র দাবিদার। আজ ভোটবিপ্লবের মাধ্যমে নতুন করে বিজয় দিবস পালনের ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে শত চাপের মুখেও ভোটের মাঠ ছেড়ে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আওয়ামী লীগের বিষফোড়া যেমন স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি, তেমনি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীও বিএনপির গলার কাঁটা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ভোটের রণক্ষেত্র সামাল দিতে এ দুই বহুরূপী হাইড্রার হাত থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বুঝি কোনোদিনই মুক্তি নেই। এরশাদ গত পাঁচ বছর সরকারি ও বিরোধী দলের সমান সুবিধাভোগী। সারাবিশ্বেই যার নজির মেলা ভার। ২০১৪ সালের মতো এবারের ভোটেও তাঁর নানা ছলাকলা জাতি উপভোগ করেছে।
অন্যদিকে ভারতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জানিয়েছেন, বিএনপি কর্তৃক জামায়াতকে ধানের শীষ মার্কা দেওয়ার কথা যদি জানতেন, তবে তিনি বিএনপির সঙ্গে ঐক্যজোট করতেন না। এমনকি বিএনপি জোট ক্ষমতায় গেলে যদি জামায়াতকে সরকারে নেওয়া হয়, তবে তিনি বিএনপির সঙ্গে জোট ভেঙে দেবেন। ভোটের শেষ সময়ে এসে জামায়াত নিয়ে এমন বাহাস হাসির খোরাক ছাড়া ভোটের কুরুক্ষেত্রে কোনো বাড়তি কার্যকারিতা দেবে না। জোটের চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর কাদের সিদ্দিকীকেও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে এবং তাদের দেওয়া ভোটের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতে হবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ কিংবা গণফোরামকে।
মোটের ওপর এই হলো বাংলাদেশের লেজেগোবরে রাজনীতি। সংবিধানের প্রস্তাবনায় অঙ্গীকার করা হয়েছে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে। সেই সংবিধান প্রণেতাদের একজন হয়েও ড. কামাল হোসেন ৭২-এর সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় প্যারার এই অঙ্গীকার গণতন্ত্রবিমুখ ধর্মগোষ্ঠী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে রক্ষা করবেন, তা এক বড় প্রশ্ন।
অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলো, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা–যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। এরইমধ্যে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বড় সংশয়ের রেখা এঁকে দিয়েছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার। এসব সত্ত্বেও জনগণ উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে মাথায় রেখে আবার যদি তাদের ভোটে নির্বাচিত করে তবে নিজেদের বদনাম ঘোচানোর সক্ষমতা কি তারা অর্জন করবে? অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সর্বমানুষের জন্য আইনের শাসন কি তারা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? নিজেরা সততার উদাহরণ হয়ে গিয়ে মানুষকে আদর্শ নৈতিকতার শিক্ষা দিতে পারবে?
আমরা চাই, দেশ থেকে গুজব, বিভ্রান্তি ও মিথ্যা চিরতরে অপসৃত হোক। গণমানুষের ভোটের জোয়ারে এমন মানুষেরা নির্বাচিত হোক, যারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে আস্থাশীল। যাঁরা হবেন, সত্য ও সুন্দরের ওপর প্রতিষ্ঠিত মানবিক সমাজ গঠনের অগ্রদূত। যারা নানামুখী অপকৌশলের ওপর ভরসাপূর্ণ রাজনীতির ছক না এঁকে নিজেদের সুবুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবেন। এই ভূমিতে বাস্তবিক অর্থেই শুদ্ধ গণতন্ত্র ফিরুক। কোনো প্রকার ভয়ভীতি, চাপ বা সংকোচন নয়। আর কোনো শূন্যতা বা হাহাকার নয়, নতুন বছরের নতুন সূর্যালোকে সবার অন্তর ভরে যাক পূর্ণতায়। তার আগে মুক্তপ্রাণ মানুষের স্বাধীন উৎসবে ভোট হোক গণতন্ত্রের সুশান্তি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।