আমরা কি আসলেই ‘বাংলা ভাষা’কে গুরুত্ব দিচ্ছি?
নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য বাঙালির ভালোবাসা কতখানি? মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালিরা নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার বিরল ইতিহাস রচনা করেছেন। ইতিহাসের আয়নায় দেখা ভালোবাসা তাই প্রবল। কিন্তু বর্তমান কি অন্য কিছুর বার্তা দেয়? সবাই নিজেকে এই প্রশ্নটুকু করুন।
আমি বাংলা বলতে এখানে শুধুমাত্র ‘প্রমিত বাংলা’কে বোঝাচ্ছি। ভাষার আঞ্চলিকতা নিয়ে আমার বরং ভালোলাগার অনুভূতিই বেশি। কিন্তু একটা আদর্শ অবস্থান ও অবস্থায় যে বাংলা আমাদের উচ্চ শিক্ষিতমহল ব্যবহার করেন বা করার চেষ্টা করেন, আমি তার কথা বলছি। নানা অঞ্চলের নানা ধরন ও উচ্চারণ বাংলা ভাষার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু ‘আদর্শ বাংলা’ বলে একটা কিছু আছে এবং অনেকেই সেটি সাফল্যের সাথে চর্চা করেছেন।
মানুষ তার নিজের জগতে, পরিবারে, বন্ধু-বান্ধবের সাথে পরিচিত এবং অভ্যস্ত উচ্চারণেই যোগাযোগের কাজ সারেন। চট্টগ্রামের একজন মানুষ তার পরিবারে, একান্ত ব্যক্তিগত জগতে, বা একই অঞ্চলের মানুষের একটি সমাবেশে নিজের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে পারেন; বরং কার্যকর যোগাযোগের খাতিরে কখনো কখনো আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা বেশি কাজে আসে। কিন্তু একই মানুষ যখন কোনো বড় পরিসরে, নানা স্থানের বাঙালির সামনে কথা বলবেন, তখন সবাই আশা করেন তিনি আদর্শ বাংলায় কথা বলবেন। বিশেষ করে যারা সমাজের নানা উচ্চপদে আসীন, তাঁদের কাছ থেকে এমন আশা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা কি সকল ‘উচ্চশিক্ষিত’ মানুষের মুখ থেকে শুদ্ধ বা মোটামুটি শুদ্ধ বাংলা পাচ্ছি? পাচ্ছি না। যাদের ভিডিও ইউটিউবে বা ফেসবুকে আসে তাঁদের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বাংলা সম্পর্কেই আমরা শুধু জানি।
গ্রামের স্কুল-কলেজ এর কথা বাদ দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষে কতজন শিক্ষক ‘ভালো’ বাংলায় কথা বলতে পারেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলে-মেয়েরা কতজন মোটামুটি বাংলায় কথা বলতে পারছেন? যারা পারছেন তারা পরিবার বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিখে আসছেন; কিন্তু যারা পারছেন না, তাদের সংখ্যাই তো বেশি। ভালো বাংলা বলতে অক্ষম ‘শিক্ষিত’ জনগোষ্ঠীকে ভাষা বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কি? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কতজন ‘শুদ্ধ’ বাংলায় কথা বলতে পারছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি। উত্তর জানলেও পরিস্থিতির উত্তরণে আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় প্রয়াস নেই বললেই চলে।
প্রয়াস নেই, তাই ফলও ভালো নয়। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে আমাদের নানা ধরনের অনুষ্ঠান, বক্তৃতার বাড়াবাড়িতে ভাষা শহীদদের স্মরণ করি। কিন্তু নিজেদের জীবনে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় মন থেকে চেষ্টা করছি কি? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইংরেজি পারা, না পারাকে আমরা যেভাবে ‘ভালো ছাত্রে’র মানদণ্ড হিসেবে নিই, এর কাছাকাছি গুরুত্বও আমরা বাংলাকে দেই না। আবার সর্বস্তরে বাংলা চালুর বাহাদুরি করতে গিয়ে ভালো ইংরেজি জানবে এমন ব্যবস্থাও আমরা বন্ধ রেখেছি। এর ফলে না পারছি বাংলা জানতে, না পারছি ইংরেজি জানতে। একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা। কোথায়, কীভাবে ভালো বাংলা বলতে হবে সেটা যেমন আমরা জানি না, আবার দরকারের সময় ভালো কার্যকর ইংরেজিও আমরা বলতে পারছি না। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজির কথা আসল, কারণ মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি জানাটা ঐতিহাসিক কাল থেকে এ দেশে নয় শুধু, বিশ্বের নানা প্রান্তে বাড়তি ‘যোগ্যতা’ হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে।
আমাদের নেতৃস্থানীয়রা বাংলাকে সমাজের সর্বস্তরে চালুর জন্য খুব ‘চাপাচাপি’ করে থাকেন। খুবই বৈজ্ঞানিক চিন্তা থেকে যে এই মহতী প্রয়াস সেটি বলাই বাহুল্য। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সমাজ এবং রাষ্ট্রের যারা নীতি-নির্ধারক তাঁদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের কতজনকে ভালো বাংলা শেখাচ্ছেন? সমাজের ‘বড়’ মানুষেরা তাঁদের সন্তানদের কতজনকে বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করাচ্ছেন? একটি জরিপ করে আমার অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যায়। সমাজে এবং রাষ্ট্রে জাতে উঠতে গেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া যেন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করছে এটি শুনতে কিংবা শোনাতে কোনোটাই আমাদের ভালো লাগে না। বিত্তশালীরা লজ্জা পায়। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তরা খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর চেষ্টা করে।
বাংলা যেন দিন দিন ‘গরিব’ ও ‘সম্মানহীন’ মানুষের পড়াশুনার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই বাংলা মাধ্যমে সাধারণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পড়াশুনা করা ছেলেমেয়েরাই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েদের সিংহভাগ সময়-সুযোগ বুঝে বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশের শীর্ষ আমলা, ব্যবসায়ী আর এক শ্রেণির রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়েরা বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ ডলার খরচ করে পড়াশুনা করছে। এদের একটা অংশ আবার সুযোগ বুঝে দেশে ফিরে দেশের শীর্ষস্থান দখল করছে। তাদের ছেলেমেয়েরা আবার একই পন্থা অবলম্বন করে এই ধারা বজায় রাখে। এভাবেই আভিজাত্যের দুষ্ট চক্র বেঁচে থাকে আর কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রিয় বাংলাদেশকে। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। কিছু মানুষ আবার বিদেশের আরাম-আয়েশ ফেলে দেশের ধুলা-মাটিতে পড়ে থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা স্থাপনের আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতি আমাদের প্রণাম। কিন্তু এমন মানুষ খুব বেশি নেই দেশে।
নিজের ভাষা ও কৃষ্টি ছেড়ে ভিনদেশি কালচার বা সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে যারা ‘বিশেষ জ্ঞান’ অর্জনের দৌড়ে আছে তারা যে সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে, সেটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত। দেশের জঙ্গিবাদ সমস্যার দিকে যদি আমাদের দৃষ্টি যায়, আমরা দেখব, ইংলিশ মিডিয়াম আর মাদ্রাসায় পড়া ছেলেমেয়েদের একটা অংশ জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। বাংলা মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর সংখ্যা খুব কম।
মাতৃভাষা শুধু ভাষা নয়, এটি একজন মানুষকে তৈরি করে মাটি ও মানুষের সাথে জুড়ে দেয় প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধনে। বাংলা ভাষার শক্তিতে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র অর্জন করেছে, এটি কোনো অতিশয়োক্তি নয়। বঙ্গবন্ধু এই বাংলা ভাষাতেই পুরো বাঙালি জাতিকে তৈরি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা ভাষা চালুর দাবির বিপক্ষে যারা, তাদের অনেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসেন। জাতির পিতা বলেছিলেন ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। ‘দাবায়ে’ না বলে তিনি ‘দাবিয়ে’ বলতে পারতেন। ‘পারবা না’ না বলে ‘পারবে না’ বলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির মহাকবি। মহাকবিরা শব্দ নিয়ে অনেক খেলতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ শৈলী তাই ব্যতিক্রম, বিশেষ।
বাংলা ভাষা দূষণের শিকার। রেডিও, টেলিভিশনে অনেক নাটক, অনুষ্ঠানে অদ্ভুত ধরনের ভাষা বলা হয়। বাংলা ভাষার যেন সম্ভ্রমহানী করা হয় কিছু নাটক ও অনুষ্ঠানে। নাটক-সিনেমায় চরিত্রের খাতিরে পুরান ঢাকার বাংলা বা সিলেট, চট্টগ্রামের বাংলা আসতে পারে। এমনকি পুরো নাটক বা সিনেমাও আঞ্চলিক ভাষায় হতে পারে, যদি চরিত্রসমূহ সেরকম হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অধিকাংশ এফএম রেডিও এবং কিছু টেলিভিশন নাটকে একধরনে ‘খিচুড়ি বাংলা’ চর্চা করা হচ্ছে। অনেক নির্মাতা একে দর্শক-শ্রোতার চাহিদা বলে চালিয়ে দিতে চান। অথচ ৯০-এর দশকের বাংলা টেলিভিশনের নাটকগুলো দেখুন। সেখানেও কোনো কোনো চরিত্র আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেছে। কিন্তু নাটকগুলো লেখা হয়েছিল মূলত প্রমিত বাংলায়। এবং প্রায় প্রতিটি নাটকই জনসমাদৃত হয়েছিল। তাই দর্শকদের চাহিদার কথা বলে খিচুড়ি ভাষায় নাটক-অনুষ্ঠান নির্মাণের চর্চাকে উৎসাহিত করার কোনো সুযোগ নেই। রুচিশীল দর্শক-শ্রোতা তৈরি করাও গণমাধ্যমের কাজ।
‘সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা চর্চা’ তাই শুধু মুখের বুলি বা স্লোগান হয়েই না থাকুক। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা, শীর্ষ আমলা, সুশীল ও বিত্তশালী অংশ নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একই চেতনা ছড়িয়ে দিন। জাতীয় ভাষা শহীদ দিবসে এই আমাদের কামনা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।