দৃষ্টিপাত
সীসার ঝুঁকিতে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশিরা
নিউইয়র্কে বসবাসকারী দক্ষিণ এশীয়, বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মারাত্মক সীসার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে শিশুদের জন্য এই সংকট অনেক বেশি বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনাচরণের কারণে প্রতিনিয়ত অনেকের রক্তে লেড বা সীসার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন তারা। এর ফলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতিসহ হাত পা ঝিম ঝিম করা, অবশ লাগা, বিষণ্ণতা, স্মৃতিশক্তি হারানো, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, মুখের স্বাদ বদলে গিয়ে বিস্বাদ, রক্ত শূন্যতা, রক্ত ভেঙ্গে গিয়ে লোহিতরক্ত কণিকার পরিমাণ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।
নিউইয়র্কভিত্তিক সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান 'দ্য অপটিমিস্ট'-এর আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা এসংক্রান্ত নানা তথ্য তুলে ধরেন। এতে বক্তব্য দেন সংগঠনের সহসভাপতি ও বিশিষ্ট চিকিৎসক ফেরদৌস খন্দকার, শিশু বিশেষজ্ঞ ফজলুল ইউসুফ ও নিউইয়র্ক সিটি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আসা বিশেষজ্ঞরা। সোমবার সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে নিউইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে দেখান, কীভাবে দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে সীসার মাত্রা বাড়ছে। তার জন্যে খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনাচরণকে দায়ী করেন তারা। খাবারে নিজেদের দেশ নিয়ে নিয়ে আসা মশলাগুড়ার কারণে নানা সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া কাজল, সুরমা, সিঁদুরের ব্যবহার, আয়ুর্বেদিক, হারবাল, টোটকা চিকিৎসা, খাবারের থালা থেকেও সীসা ছড়াচ্ছে বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।
ড. ফেরদৌস খন্দকার এসময় বলেন, '‘সীসা’ বা ‘লেড’ এমনই একটি পদার্থ যা মানুষের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই ক্ষতি মারাত্মক'। কীভাবে এটি ছড়ায় তা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন,' খাবারের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। খালি পায়ে হাঁটলে কারো শরীরে ভেতরে নিরবে ঢুকে পড়তে পারে এই ঘাতক। যেসব এলাকায় নানা ধরনের কারখানা রয়েছে, সেখানে উৎপাদিত পণ্যে সীসার মাত্রা বেশি থাকে। ওই সব এলাকার বাতাসের মাধ্যমেও শরীরে সীসা ঢুকে যেতে পারে। শিশু যদি সেখানে হামাগুড়ি দেয় তাহলে ধূলার মাধ্যমে শিশুর রক্তে সীসা মিশে যেতে পারে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'নিউইয়র্কে পরিবেশগত সংকট অতটা প্রকট নয়। এখানকার সমস্যা দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে নিজেদের মতো করে জীবনযাপন ও খাদ্যগ্রহণ। সীসার সংকট থেকে মুক্ত থাকতে হলে অবশ্যই সচেতন হতে হবে বলে মত দেন শিশু বিশেষজ্ঞ ফজলুল ইউসুফ। তিনি বলেন, 'সতর্ক হয়ে উদ্যোগ না নিলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি নেই।’
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বক্তারা জানান, ‘স্বাভাবিকভাবে শিশুদের শরীরে সীসার পরিমাণ পাঁচ মাইক্রোগ্রামের নিচে থাকার কথা। পরিণত বয়সে রক্তে এর উপস্থিতি হওয়া উচিত দশ মাইক্রোগ্রামের নিচে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’
ডা. ফেরদৌস খন্দকার বলেন, ‘চিকিৎসায় হয়তো রক্তে এই ধাতবের পরিমাণ কমে, কিন্তু ব্রেন বা কোষে যে ক্ষতি হয়ে যায় তা আর ফিরে আসে না। আর সেজন্যেই এটির প্রতিরোধ খুব জরুরি।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন অপটিমিস্টের সাধারণ সম্পাদক নিশাদ হক, কার্যকরী কমিটির সদস্য মিনহাজ আহমেদ। তারা জানান, ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করা ‘দ্য অপটিমিস্ট’ একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মানবতার কল্যাণে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সংগঠনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিতদের শিক্ষার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। বিশেষ করে সংকটাপন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করে অপটিমিস্ট। সেই সঙ্গে কল্যাণমুলী নানান কাজের সঙ্গে যুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি।
উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের ২৫টি জেলায় এই প্রতিষ্ঠানটি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। উল্লেখযোগ্য জেলার মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি। এই সংগঠনের মাধ্যমে বিগত দেড় দশকের বেশি সময়ে আনুমানিক দেড় মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ পাঠানো হয়েছে। যার অর্থে দেশের তিন হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে ও তাদের পরিবার বছরের পর বছর উপকৃত হচ্ছে। এরমধ্যে সাভারের রানা প্লাজায় নিহত পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্কুল-কলেজগামী ৭৯জন ছেলেমেয়ে রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অপটিমিস্টের আওতায় প্রসুতি ও নবজাত সন্তানের সেবায় ফ্রি চিকিৎসাসেবা, জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক