অভিমত
দক্ষিণ কোরিয়ায় ও বাংলাদেশে আশির দশকে গণতন্ত্র
সাল ১৯৮০, ১৮ মে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শহর যার নাম গোয়াংজু। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ষষ্ঠ বৃহত্তম নগরী। গোয়াংজু মূলত জিওন্নাম প্রদেশের রাজধানী। এই শহরটির অন্য একটি পরিচয় রয়েছে, তা হলো এই শহরটিকে প্রো-ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের সূতিকাগারও বলা হয়ে থাকে। উল্লিখিত দিনটিকে গণতন্ত্রের উত্থানের দিন বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ কোরিয়াতে। গোয়াংজু শহরটি তৎকালীন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে ছিল বেশ পিছিয়ে পড়া একটি শহর। আর তাই শহরজুড়ে বিশেষত চোন্নাম ও চোসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে যাত্রা শুরু স্কুল ডেমোক্রেটাইজেশনের। তারাই প্রথম শুরু করেন, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার। ছাত্র সংসদের নির্বাচনে আইন বিভাগের ছাত্র পার্ক জিওন হিওনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার মাধ্যমে সেই গণতান্ত্রিক আন্দলনের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয় তাকে। তারই নেতৃত্বে সুসংগঠিত হতে থাকে গোয়াংজু শহরের ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে গোটা গোয়াংজুবাসী।
কিন্তু এই আন্দোলনে বাঁধ সাধে তৎকালীন সামরিক শাসন ব্যবস্থা । তৎকালীন সামরিক শাসক চুন দো হুয়ান কর্তৃক ঘোষিত মিলিটারি ল-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে সমগ্র গোয়াংজুবাসী। ১৫ মে, ১৯৮০, এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ছাত্র-শিক্ষক সমবেত হয়ে দেশটির জাতীয় পতাকা হাতে নেমে পড়ে শহরের রাজপথে । এই আন্দোলনকে বাধা দিতে নামানো হয় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। চোন্নাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে মুখোমুখি উভয় পক্ষ। পরবর্তী দিন ১৬ মে সমগ্র জনতা একত্রিত হয় শহরের প্রভিন্সিয়াল হলের সামনে। ডাক দেয় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। সেদিন রাতেই ওই স্থানে মশাল প্রজ্বালনের মাধ্যমে জানান দেয় তীব্র আন্দোলনের। সামরিক শাসক আর স্থির থাকতে পারল না। নেমে পড়ল জিওন্নাম শহরের পথে পথে। বিশাল বিশাল ট্যাংক আর অস্ত্রসহ নির্বিচারে আক্রমণ করল সাধারণ জনগণের ওপর। আহত সহস্রাধিক। অনেককেই আটক করা হলো। বীভৎস রকম নৃশংসতায় মেতে উঠল তৎকালীন সামরিক শাসক। ফলাফল ৪৪০৬ জন আক্রান্ত। এর মধ্যে ১৫৪ জনেরই মর্মান্তিক মৃত্যুর পাশাপাশি ৭৬ জন নিখোঁজ ও ৪১৭৬ জন আহত ও আটক হলেন। টানা ১০ দিনের নৃশংস অত্যাচারের সমাপ্তি হলো বহু সাধারণ জনগণের প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে। তবুও এই দেশ ভুলতে পারেনি সেই নৃশংসতাকে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর সেই নৃশংসতাকারীদের বিচার করে বর্তমান আধুনিকতার শীর্ষে থাকা এই দেশটির গণতান্ত্রিক সরকার।
এসবই জানতে পারলাম বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইন কোরিয়ার শীতকালীন মিলনমেলা ২০১৯ সালে গোয়াংজুতে আসার কারণে। মিলনমেলার দ্বিতীয় দিন গোয়াংজু শহর থেকে কিছুটা দূরে মে ১৮ ন্যাশনাল সেমিট্রিতে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত ভ্রমণ সূচি ছিল। এখানে আসতেই কর্তৃপক্ষ প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখাল যাতে আমার পূর্ব বর্ণিত সমস্ত ঘটনাবলীর ধারাবাহিক চিত্র আমার দৃষ্টিগোচরে আসে। তৎক্ষণাত আমার অবচেতন মনে ভেসে ওঠে প্রায় সমসাময়িক বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সূচনালগ্ন ও তখনকার একই সাথে গৌরবময় অন্যদিকে বিভীষিকাময় গণআন্দোলন ও গণজাগরনের ইতিহাস। সেই সূত্র ধরেই আসলে এই লেখাটা শুরু করা।
আমরা অনেকেই হয়তো জানি আবার অনেকেই জানি না। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আমরা ভালোবাসার আদলে এমন ভাবে সাজাই প্রতি বছর, তাই হয়তো আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা অনেকেরই মনে ভাসে না। বিশ্ব ভ্যালেন্টাইন্স ডে। কিন্তু ১৯৮৩ সাল, এই দিনটিতে আরো একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকেই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে বর্ণনা করেন। আসুন আমার ইতিপূর্বের দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কোনো মিল খুঁজে পাই কি না দেখি!
১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান এক বিতর্কিত শিক্ষানীতির ঘোষণা দিলে চোন্নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর এই নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনের ডাক দেন আপামর ছাত্র সমাজ। পরে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা সচিবালয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বটতলায় সকাল ১০টায় এক সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু সেই সমাবেশকে বানচাল করার জন্য পুলিশ চড়াও হয় নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে প্রায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে, যদিও সরকারি তথ্যে দেখানো হয় মাত্র দুজন। বাকিদের লাশ খুঁজে পায়নি তাদের সজনরা। পরে এইদিনটিকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করা শুরু হয়। আহ। বাতাসে শুধু লাশের গন্ধ । অনেকটা সেই সত্যিকারের ভ্যালেন্টাইন্স-এর গল্পেরই মতো করুণ পরিণয় হয়েছিল, আমার দেশের গণতন্ত্রের সূচনা করা সেই জয়নাল, মোজাম্মেল আইয়ুবসহ ভালোবাসার মানুষগুলোর। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কিছুটা পরের গল্প অবশ্য অনেকেরই জানা।
গল্পটি শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জীবন নিয়ে নির্মিত ‘হাসিনা : আ ডটার্স টেইল’-এও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন এই শহীদ নূর হোসেনের কথা। সেদিন প্রধানমন্ত্রী নিজেও শামিল ছিলেন এই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। সাল ১৯৮৭, স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে বুকে পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক'। আহ কি প্রতিবাদের ভাষা! সশ্রদ্ধ সালাম আপনাকে। সেদিন কিন্তু নূর হোসেনের সাথে তৎকালীন যুবলীগের আরেক নেতা নূরুল হুদা ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের খেতমজুর নেতা আমিনুল হুদাও শহীদ হন। অনেকটা দক্ষিণ কোরিয়ার সমসাময়িক সময়েই বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের সূচনা হয়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তখন শেওড়াপাড়াতে থাকি। আমাদের বর্তমান বাসাটি পরিপূর্ণভাবে তখনো বাবা নির্মাণ করতে পারেননি। যদিও আজ পর্যন্ত আংশিকই নির্মিত। সেই আংশিক দালানের চিলেকোঠা ধরে আমার সেকি ছোটাছুটি। আমি তখন সম্ভবত ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আজ এতটা বছর পর কেন মিল খুঁজে ফিরি এই দুটো ঘটনার তেতর! বলতে পারবেন?
আজ আমরা কোথায়, আর দক্ষিণ কোরিয়া কোথায়! দোষ কি শুধু সরকার ব্যবস্থার? আপনার আমার কি কোনোই দোষ নেই? কতটুকু গণতান্ত্রিক চর্চা করেছেন? হয়তো বলবেন চর্চা তো করতে দেয় না। তাহলে জয়নাল, নূর হোসেনরা কীভাবে পারল? আর আসলে আমি তো আর আন্দোলনের কথা বলছি না। এখন আমাদের দেশে অত্যন্ত স্থিতিশীল একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। এখন তো আমাদের রাজপথের আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন গোল-টেবিল বৈঠকের। তাই বলে তথাকথিত টক শোর কথা বলছি না। দেখুন পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেখেছি, জন প্রতিনিধিরা একে অন্যের সাথে বাৎসরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত বিতর্ক করেন। সবাই নিজেদের একটা পরিকল্পনা দেন ও এই নিয়ে যার যার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এই নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা হয়। পরবর্তী সময়ে জনগণই সিদ্ধান্ত নেয় কার পরিকল্পনাটি সময়োপযোগী ও উন্নয়ন পথগামী। এভাবেও কি গণতন্ত্রের চর্চাটা করা যায় না! আরো বহু কথা লেখা যায়। কাজে আসবে কি! অনুরোধ নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সঠিক গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। নিজেকে রাজনীতির বাইরে রেখে নয়, নোংরা রাজনীতির ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে সুনিপুণ হাতে পরিষ্কার করতে হবে ময়লা আবর্জনাকে। তবেই না সঠিক দেশপ্রেমী হতে পারবে, গড়তে পারবে সেই সোনার বাংলাদেশ। আমার তো বয়স হলো, এবার তোমাদের পালা বন্ধু। আমি না হয় শুধু ভালোবাসাই দিয়ে যাই। তবে সাধ্য মতো চেষ্টা করব যতটুকু সাধ্যে কুলায়। এই আমার আজকের অঙ্গীকার । খুঁজে পেলাম সেই গণতন্ত্র, সঠিক গণতন্ত্র- রিয়েল ডেমোক্রেসি।
লেখক : কৃষিবিদ, উপজেলা কৃষি অফিসার (এলআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ী, ঢাকা।