ভেবে দেখুন
সেলফি তোলা কি মানসিক রোগ?
সম্প্রতি একদল মার্কিন গবেষক দাবি করেছেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার অভ্যাসের সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্ক থাকতে পারে। নিজের চেহারার প্রতি এই আকর্ষণ অনুভব করা মানসিক স্বাস্থ্যকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) সম্প্রতি মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করে। শুধু তাই নয়, বেশি মাত্রায় নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করার এই প্রবণতাকে গবেষকরা বলছেন এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যাকে বলা হয় ‘সেলফাইটাস’(Selfitis)। মার্কিন পত্রিকা ফোর্বসসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
সেলফোন ও সেলফি
অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আপনার স্মার্ট ফোন আছে এবং আপনি তাতে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি স্মার্ট ফোন থাকার পরও আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট না থাকে বা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকার পরও আপনি সেলফি না তোলেন বা সেলফি ম্যানিয়ায় আক্রান্ত না হন, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি অন্যের চেয়ে আলাদা। কেননা সেলফি তোলার এই প্রবণতা কেবল সাধারণ মানুষের নয়, পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে হলিউড স্টার এমনকি পোপ ফ্রান্সিসেরও রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, ২০০২ সালে একটি অনলাইন ফোরাম প্রথম ‘সেলফি’শব্দটি ব্যবহার করে। যার সংজ্ঞায় বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে নিজের মানসিক অবস্থা জানাতে নিজের তোলা ছবি, নিজের সম্পাদনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তুলে দিয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুদের জানানো। তবে ফেসবুকের আগে মাইস্পেস বেশ জনপ্রিয় ছিল এবং সে কারণে সেলফি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় সেখানেই।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে সেলফি শব্দটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে শব্দটি সংযোজিত হয়। আর ২০১২ সালের শেষদিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে শব্দটি বছরের আলোচিত সেরা ১০ শব্দের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেলফি ও নার্সিসিজিম
এডিথ হ্যামিল্টনের ‘মিথলজি’গ্রন্থের ১০২ ও ১০৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘নার্সিসাস’নামে গ্রিক পুরানের এক যুবকের গল্প রয়েছে।‘নার্সিসাসের সৌন্দর্য এমনই রমণীমোহন ছিল যে, কোনো কুমারি তাকে একবার দেখলেই তার প্রেমে পড়ে যেত, কিন্তু যুবক নার্সিসাস কাউকেই কখনো কামনা করত না। সে সবচেয়ে সুন্দরীকেও অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করত অবলীলাক্রমে। নার্সিসাসের শাস্তি চেয়ে প্রত্যাখ্যানে বিদীর্ণ কোনো নারীর প্রার্থনার উত্তরে দেবতারা বললেন, হয়তো সে (নার্সিসাস) অন্যকে নয়, কেবল নিজেকেই ভালোবাসে।
একদা নার্সিসাস এক স্বচ্ছ জলাশয়ের ওপর অবনত হলো পানি পানের আশায় এবং দেখতে পেল তার নিজের প্রতিবিম্ব। তাৎক্ষণিক সে তার প্রেমে পড়ে গেল। নার্সিসাস বলে, আমি এখন বুঝতে পারছি। সে চিৎকার করে বলল, অন্যরা আমার কাছ থেকে কত যন্ত্রণা পেয়েছে। কারণ আমি আমার নিজেরই প্রেমে পড়ে যন্ত্রণার দহনে দগ্ধ হচ্ছি। তথাপি আমি কীভাবে এই জলে বিম্বিত অপরূপ সুন্দরের কাছে পৌঁছাতে পারি? কিন্তু আমি তো একে ত্যাগ করতে পারি না। কেবল মৃত্যুই আমাকে মুক্তি দিতে পারে এবং তাই ঘটল। সেই জলাশয়ের ওপর দিনের পরের দিন পলকহীন তাকিয়ে থেকে সে ক্রমশ শীর্ণ হয়ে গেল এবং একদিন মৃত্যু হলো ।
নার্সিসাসের এই গল্প এতই জনপ্রিয় হয় যে, এখন কেউ যদি নিজেকে বেশি ভালোবাসে, নিজের রূপে মুগ্ধ হয়, তাহলে তাকেও নার্সিসাস বলে তিরস্কার বা অভিযুক্ত করা হয়; তা সে নারী বা পুরুষ যেই হোক। আর এ থেকেই এসেছে নার্সিসিজম শব্দটি, যার অর্থ নিজের রূপে মুগ্ধ হওয়া বা কেবল নিজেকেই ভালোবাসা। আর এই নিজেকে ভালোবাসা থেকেই সেলফির উৎপত্তি।
সেলফি ও সেলফিটিজ
স্যামসাংয়ের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি মানুষের তোলা ছবির ৩০ শতাংশই সেলফি। আর স্মার্টফোনের কল্যাণে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বেই সেলফি এখন তুমুল জনপ্রিয়। সেলফি শব্দটিকে অনেকে বাংলায় ‘নিজস্বী’বলে থাকে।
ফেসবুকে প্রতিনিয়তই নানা ঢংয়ের, নানা রঙের নানা মানুষের, নানা ভঙ্গির সেলফি দেখা যায়। অন্যের তোলা ছবির সঙ্গে সেলফির পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। কেননা মানুষ যখন তার নিজের ছবি তোলে তখন সেখানে পোজের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক সময়ে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ক্লিক করার ব্যাপারটিও থাকে। ফলে তাকে একইসঙ্গে দুটি কাজ করতে হয়। দ্বিতীয়ত নিজের ছবিটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে সঠিকভাবে আনতে গিয়ে যে শারীরিক কসরত করতে হয়, তাতে অনেক সময়ই দেখা যায় অনেকের মুখভঙ্গি বদলে বিকৃত হয়ে যায়। অথচ অন্য কেউ যদি তার এ রকম ছবি তুলত, তাহলে সে ওই ছবি ফেসবুকে দিত না। কিন্তু সেলফি অর্থাৎ নিজের তোলা প্রতিকৃতি নন্দনতত্ত্বের বিবেচনায় যত খারাপই হোক, তা আপলোড করতে কেউ দ্বিধা করে না।
আবার সেলফি যে শুধু নিজের ছবিই তোলা তা তো নয়। বরং একসাথে অনেককে নিয়েও সেলফি তোলা হয়। এ কারণে মোবাইল ফোন থেকে ভালো মানের সেলফি তোলার জন্য এখন সেলফি স্টিকও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আবার ব্লুটুথসহ সেলফি স্টিকও বাজারে মিলছে এক হাজার টাকার মধ্যে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে এক সংগীতানুষ্ঠানে সেলফিস্টিক নিষিদ্ধ করা হয়। আয়োজকদের যুক্তি, সেলফি তোলাকে কেন্দ্র করে সে দেশে নানা বিপত্তি ঘটছে। জ্ঞানশূন্য হয়ে বহু সেলফিপ্রেমী দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তাই এই সেলফি স্টিক বাতিল।
সম্প্রতি নিজের ছবি তোলা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় একটি গবেষণা হয়। যেখানে দেখা যায়, সেলফি পোস্ট করার পেছনে মানুষের যতখানি না লোক দেখানোর বিষয় থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ ও নিজের সম্পর্কে জানার আগ্রহ। ছুটির দিন ও সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ড উপলক্ষে মানুষ বেশি নিজের ছবি তুলে রাখে। গবেষকরা বলেন, নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পেতে সেলফি পোস্ট করে অনেকে। আমি কে বা আমি কী করি, তা জানাতেই অনেকে পোস্ট করে নিজের ছবি। অনেকে নিজের সম্পর্কে অন্যের মতামত জানতে বা অন্যের প্রশংসা পেতে সেলফি আপলোড করে থাকে।
সেলফির বিপদ
বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশের কাছেই মোবাইল ফোন আছে। আর স্মার্ট ফোনের দামও এখন হাতের নাগালে। ফলে দেখা যাচ্ছে মানুষে মানুষে সামাজিক যোগাযোগ কমে গেলেও অনলাইন যোগাযোগটা বাড়ছে। ডিজিটাল ক্যামেরা, স্মার্টফোনে নিজের ছবি তুলে তা ফেসবুক, টুইটারে শেয়ার করে অন্যের মতামত পাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
তবে সেলফির কিছু বিপত্তিও আছে। কেননা বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, নানা ঢঙে, বিভিন্ন স্থানে এবং অনেক কিছু সাথে নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে এ যাবত অসংখ্য দুর্ঘটনাও ঘটেছে। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। বিশেষ করে ব্যতিক্রমী সেলফি তুলে ইতিহাস হতে গিয়ে অনেক তরুণ-তরুণী সত্যি সত্যিই ইতিহাস হয়েছে।
অস্কার অটেলো আগুইলার নামের এক তরুণ বন্ধুদের সাথে মদ পান করে একটি পিস্তল নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে ভুলক্রমে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে দেন। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। রেগাইটন জাডিয়েল নামের একজন মোটরবাইক চালানো অবস্থায় সেলফি তুলতে যান এবং দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার সময় পড়ে যান জিনিয়া লেগ্নাটেভার। একটি বৈদ্যুতিক তারের ওপর পড়ে গেলে মারাত্মক শকে তাৎক্ষণিকভাবেই মৃত্যু হয় তাঁর।পর্তুগালের একদম্পতি কাবো ডা রোকা পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার সময় প্রায় ২০০ ফিট উচ্চতা থেকে পড়ে মারা যান। এ রকম অনেক দুর্ঘটনার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ কিশোরের গল্প
সহপাঠীকে নগ্ন সেলফি পাঠিয়ে বিপদে পড়েছেন যুক্তরাজ্যের এক স্কুলছাত্র। পুলিশ ঘটনাটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। তবে ওই কিশোরের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি। তাকে আটকও করা হয়নি। বরং পুলিশ বলছে, তার নাম পরিচয় আগামী ১০ বছর পর্যন্ত পুলিশের ডাটাবেইজে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পুলিশ যদি মনে করে, তাহলে ভবিষ্যতে এই কিশোর যেখানে চাকরি করতে যাবে সেই প্রতিষ্ঠানকে তার এই ঘটনা জানানো হতে পারে। সেই কিশোর বিবিসির রেডিও ফোরে টুডে অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, সে তার শোবার ঘরে নিজের একটি নগ্ন ছবি তুলে তার এক সহপাঠী কিশোরীকে ‘স্ন্যাপচ্যাট’নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। কিশোরী ওই ছবিটি তার মোবাইল ফোনে সেভ করে নেয় এবং এরপর সেই ছবি স্কুলের অন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাঠায়। বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষ পুলিশের নজরে আনে। তবে ওই কিশোরের মায়ের দাবি, তার সন্তান না বুঝে কাজটি করেছে।
সেলফি বনাম অন্যের বিরক্তি
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ছবি পোস্ট করা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। কোন ছবি আপনি ফেসবুক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, কোনটি করবেন না, কোন ছবিটি আপনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির সঙ্গে বেমানান, সেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
ইউরোপ আমেরিকার বারে বসে সেলফি তুলে সেটি ফেসবুকে পোস্ট করার মধ্যে হয়তো কোনো অপরাধ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো, তাতে আপনি বারে বসে কিংবা মদের গ্লাস হাতে সেলফি তুলে তা পোস্ট করবেন কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। অনেকে প্রিয়জনের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে তোলা ছবি পোস্ট করে। কখনো কখনো সেসব ছবি আপত্তিকরও মনে হতে পারে। ফলে ছবি পোস্ট করার আগে বিবেচনায় রাখা দরকার, ছবিটি অন্যের বিরক্তির কারণ হবে কি না।
কেননা নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার পর তাতে যে মন্তব্য বা লাইক আসে তার ওপর ভিত্তি করে নিজের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা ঠিক নয়। নিজের আত্মবিশ্বাস ও অতি-আত্মবিশ্বাসের মধ্যে সীমারেখা থাকতে হবে। অনেকে ঘন ঘন সেলফি পোস্ট করে আবার অযাচিতভাবে অন্য বন্ধুদের ট্যাগ করে। এটিও কখনো কখনো অন্যের বিরক্তির কারণ হতে পারে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর