উগান্ডা সিনড্রোম
বেশ অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের অনেক ইস্যু নিয়ে নিয়ে উগান্ডার নাম ধরে ট্রল চলেছে। এবার সত্যি সত্যি সেই উগান্ডার বাস্তবতা ধরা দিল আমাদের কাছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা ২৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘প্রশিক্ষণের’ জন্য পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশে পাঠিয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের আরো ১৪ জন কর্মকর্তাও দেশটি ভ্রমণে গেছেন। সব খরচ বহন করার পাশাপাশি প্রায় দুই লাখ টাকা করে ‘পকেটমানিও’ দেওয়া হয় তাঁদের।
সত্যিটা হলো, উগান্ডার বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। সেখানে উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধারও অভাব। কিন্তু চট্টগ্রাম ওয়াসা সেখানেই শিক্ষা সফরে পাঠিয়েছে তার কর্মকর্তাদের, সঙ্গে গেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। একই প্রকল্পের অধীনে ওয়াসা, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তরের ১৫ কর্মকর্তা গেছেন নেদারল্যান্ডসেও। এর আগে আমরা জানলাম, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৬ কর্মকর্তা পুকুর খনন শিখতে বিদেশ যাচ্ছেন। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দামের একটি বই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়। ৫০০ টাকার পর্দা কেনা হয়েছে লাখ টাকা দিয়ে।
এমন অসংখ্য বিষয় আছে, আমাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করার জন্য। এসব দেখলে একটা কথাই শুধু মনে হয়, বাংলাদেশের সরকারি, আধা-সরকারি অফিসে এটাই কর্মসংস্কৃতি। জনগণের করের টাকায় চাকরি করে, সেই জনগণকে কোনো সেবা না দিয়ে, লুটপাটে ব্যস্ত থাকার এই সংস্কৃতি কেবলই বিকশিত হচ্ছে।
সরকারি অফিসকে এ দেশের মানুষ পরিমাপ করে নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা বেশ খারাপ। সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে, দেশের সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি ভীষণ খারাপ, কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে একটু ভালো হলেও হতে পারে। এই ধারণাকে অতি সরলীকরণ বলা যাবে, কিন্তু নিশ্চয়ই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
দুটি সমস্যা সেই আদিকাল থেকে—দুর্নীতি আর অদক্ষতা। কর্মচারীদের একটা বড় অংশ কাজে খুব অবহেলা করেন, সিটে থাকেন না, অফিসে বসে ব্যক্তিগত কাজ করেন, ফাইল আটকে রেখে ঘুষ খান, সেবাপ্রার্থী মানুষকে হয়রানি করেন। আরেক দিক হলো, এদের কাজে থাকে প্রচুর ভুল, যা তাদের অদক্ষতাকেই মানুষের সামনে উপস্থাপিত করে।
কিন্তু এ কথা তো সত্য, এ দেশেই অনেক সরকারি অফিস আছে, যেখানে দক্ষ কর্মচারী আছেন এবং তাঁরা পরিশ্রমও করছেন। না হলে দেশটি নিশ্চয়ই এতটা এগিয়ে যেতে পারত না। হ্যাঁ, আছেন এবং তাঁদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম এবং তাঁরা তাঁদের সহকর্মীদের দ্বারা প্রতারিত, অবহেলিত। সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে গেলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা পরিমাপ করা দরকার। সেই পদ্ধতিটা এখানে অনুপস্থিত। সরকারি দপ্তরে কর্মী-মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে কর্মীদের শাস্তি বা পুরস্কারের যথার্থ ব্যবস্থা করা এ দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাঁকিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত, কাজে গাফিলতি-গড়িমসি করেন এমন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তালিকা কোনোদিন তৈরি হয় না, প্রকাশিতও হয় না। বরং দেখা যায়, এরাই নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করেন।
দুর্নীতি উপর মহল থেকে নিচের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে বলেই বালিশ, পর্দা, পুকুর খনন আর উগান্ডা সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে। এটি এমন এক কর্মসংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে, যে বা যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তাঁরাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। এই সংস্কৃতিতে একজন কর্মচারী সৎ থাকলে তাঁর কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে।
গত বছর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে এবং পরে সরকারের দিক থেকে অনেক বেশি উচ্চারিত হয়েছে সুশাসনের কথা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রশাসনিক কাঠামোকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, পরিচালিত করতে পারে তার ওপর সুশাসন নির্ভর করে। সুস্থ কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে গেলে কাজে ফাঁকি, দুর্নীতি, কাজের অভাব, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে নজর দিতে হবে। ‘একটা সরকারি চাকরি পেয়ে গেছি, এখন যা ইচ্ছা করব, চাকরি তো আর যাবে না’– এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যে দেশের জনসেবকদের অন্তরে লালিত হয়, সে দেশে কর্মসংস্কৃতি গণবিরোধীই থাকে।
দুর্নীতি হ্রাস করা কঠিন নয় যদি সদিচ্ছা থাকে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কঠোরভাবে সেই সদিচ্ছা দেখাতে হবে। বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড, সার্জারির বইকাণ্ড, পুকুরের পর এবার উগান্ডাকাণ্ডের মতো বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না বা কথার মারপ্যাঁচে চাপা দিলে চলে না। মনে হতে পারে, বিচ্ছিন্ন সব ঘটনা, কিন্তু এগুলোর গুরুত্ব পরিমাপ করা দরকার। এসব কাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, তাদের উৎস ধরে টান দিলে জনগণের মনে আস্থা ফেরে যে, ‘না দেশে একটি শক্তপোক্ত রাজনৈতিক সরকার আছে’।
সরকারি কাজে সহকর্মীর ওপর নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ার দরুণ সবাইকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। তাই কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি আমলাতন্ত্রকেও একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটা উন্নত করার সত্যিকারের ইচ্ছা আমাদের আছে তো?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।