ছাত্র অ-রাজনীতি
বিষয়টি অবধারিত ছিল, তবুও বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না অনেকের। ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী তাহলে কঠোর হলেন। ব্যাপক চাঁদাবাজি আর নানা অপকর্মের অভিযোগের স্তূপ এমন এক জায়গায় পৌঁছাল যে শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদত্যাগ করতে হলো। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি বহাল রয়েছে এবং পদাধিকার বলে আল নাহিয়ান খান জয় ছাত্রলীগের এক নম্বর ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। আর লেখক ভট্টাচার্য এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকায় তিনিই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁরা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
দেশজুড়ে ছাত্রলীগের নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে অস্থির হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন দলপ্রধান। কিন্তু এর মাধ্যমে ছাত্রলীগে দীর্ঘদিন ধরে একটা সহিংসতা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি, নানা ধরনের বাণিজ্যের যে সংস্কৃতি চলে আসছিল তাতে কি ভাটা পড়বে? সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে একটা বার্তা সবার কাছে পৌঁছেছে যে অতি বাড় বাড়লে ভেঙে পড়তে হয়।
ছাত্রলীগ সম্মেলন করে ঠিকই, তবে নিজের কমিটি নিজে করতে পারে না। তাকে হাত পাততে হয় মুরব্বি সংগঠনের কাছে। সেখান থেকে কমিটি আসে, কিন্তু তাও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয় না সংগঠনের কর্মীদের কাছেই। প্রতিবাদ হয়, প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা হয়, এমনকি নারী কর্মীদেরও ছাড় দেওয়া হয় না। ছাত্রলীগের যখন এই অবস্থা, আরেক বড় সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলেরও অবস্থা সুবিধার নয়। সেখানেও নানা ঘটনা ও অঘটনার পর এখন মুরব্বি দল বিএনপির তত্ত্বাবধানে সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যেই সংগঠনের সাবেক এক নেতা আদালতে গিয়েছেন এবং সম্মেলন স্থগিত করতে পেরেছেন সাময়িকভাবে।
ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের প্রতিনিধি চয়ন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের প্রশাখায় পরিণত হয়েছে। ফলে ছাত্ররা তাদের নিজস্বতা হারিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। এখন ছাত্র সংগঠন আছে, ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, তা নেই। এ দেশে ছাত্র রাজনীতি এক বিকৃত রূপ ধারণ করেছে, যার পরিণতি হলো এই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও নানা ধরনের বাণিজ্য সংস্কৃতি।
অনেকে ভাবতে পারেন, ছাত্রলীগ এমনটা কেন করে? আসলে ছাত্রলীগ একাই এই কাজ করে না। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে ছাত্রসমাজ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে ছিল, সেই ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো কোনো নেতা স্বৈরাচার পতনের পর ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিলেন। আমার মনে আছে যে নেতাকে আমি মধুর ক্যান্টিনের সামনে নেমে রিকশা ভাড়া দিতে কষ্ট হতে দেখেছি, স্বৈরাচার পতনের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তাকে ঝকঝকে পাজেরো জিপে করে এসে নামতে দেখেছি।
এর পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতা মানেই ঝা চকচকে জীবন। গাড়ি, বাড়িসহ অপ্রতিরোধ্য বিলাসিতা। এই ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, আছে কেবল অর্থবিত্তের পেছনে ছুটে চলা আর নিজ সংগঠনের ভেতর নানা গ্রুপিং তৈরি করে রাখা। এটি রাজনীতি নয়, রাজনীতির ব্যঙ্গচিত্র।
যেকোনো ছাত্র সক্রিয় রাজনীতি করতে পারে, সংগঠিত হতে পারে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনের, বিশেষ করে ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল যে রাজনীতি করে, তা কোন রাজনীতি? এই উত্তর কারো জানা নেই। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু ষাটের দশকের উত্তাল সময়, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুতে ছাত্র রাজনীতি যাঁরা করেছেন তাঁরা সম্মান পেয়েছেন। আজ কেন ছাত্র রাজনীতি ঘৃণার বিষয়, কেউ কি ভেবেছে?
একটা সময় ছিল ছাত্র সংগঠনগুলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করত। ষাটের দশকের যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হতে, নব্বইয়ের গণআন্দোলন—সব ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি গণতন্ত্রে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু এখন কেন এই দশা? অত্যন্ত বেদনার বিষয় যে, নব্বইয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি গণতন্ত্রের আমলে এসে অনেক বেশি কলুষিত হয়েছে।
প্রায় ২৯ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু ডাকসু বা হল সংসদের কার্যকরী কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। ফলে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে সাহস পাচ্ছে না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলাদলির রাজনীতি এমন এক জায়গায় গিয়েছে যে এখন ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের মক শো। যে ছাত্র নির্বাচন ছিল ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব বিষয়, তা এখন মুরব্বি দলের এজেন্ডা। আর এ কারণেই ছাত্র সংগঠনের চরিত্র এবং ক্রিয়াকলাপ আর ছাত্রসুলভ নেই, হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজ মাস্তান সুলভ।
জীর্ণ থেকে জীর্ণ আজ ছাত্র রাজনীতির মূল্যবোধ। ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খলা থামাতে প্রধানমন্ত্রীকে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে হলো। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। একটি বার্তা সবার কাছেই যাবে যে অন্যায় করলে শাস্তি অনিবার্য। কিন্তু যে ভাইরাস আজ এই ছাত্র সংগঠনকে আক্রান্ত করেছে, তা কি এত সহজে নিরাময়যোগ্য। শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে গেলে একটি অঙ্গ ফেলে কোন বড় উপকার হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, তা কি আদৌ রাজনীতি? নাকি শুধু তাণ্ডব আর নৈরাজ্যবাদ?
কলেজ হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রখ্যাত হোক বা অখ্যাত, দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সৃষ্টি করা বিশৃঙ্খলার খবর ইদানীং প্রায়ই শিরোনামে আসছে। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে, হিংসাত্মক হানাহানি চলছে, প্রকৃত শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষক-অধ্যাপকরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই পরিস্থিতি বহু চর্চিত একটি প্রশ্নকে আবার খুব বড় করে তুলে ধরছে—ছাত্র রাজনীতির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? ছাত্রদের কি রাজনীতি করার অধিকার আদৌ থাকা উচিত?
ছাত্র রাজনীতির এতখানি গুণগত অধঃপতন এ দেশে আগে কখনো দেখা যায়নি। অভূতপূর্ব নিম্নগামিতার সাধনা শুরু হয়েছে যেন। কিন্তু আমরা একটু শিক্ষকদের নিয়েও ভাবতে চাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উন্নয়নকাজের বাজেট থেকে এই ভাগ দেওয়া হয়। রাব্বানী আবার উপাচার্যের কাছে এর ন্যায্য হিস্যা চেয়েছিলেন। অভিযোগ সত্যি কি মিথ্যা, সেই তর্কের চেয়ে বড় হলো একজন উপাচার্য নিজেকে কোথায় নিলে বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে ধারণা কোথায় পৌঁছালে এমন একটা অভিযোগ উঠতে পারে। উপাচার্য অভিযোগ অস্বীকার করছেন, আবার করছেনও না। এই এক অভূতপূর্ব পথে চলছেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া এই বিস্ময়কর দৃশ্য যদি রাষ্ট্রের বা সরকারের সম্বিত না ফেরায়, তা হলে ছাত্র রাজনীতি শুধু নয়, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো অনেক অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্য বোধ হয় অপেক্ষায় থাকবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।