বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি স্বার্থান্ধতার কবলে?
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি, প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলীয় আধিপত্য, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি ইস্যুতে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে উত্তাল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় এক কথায় বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বার্থান্ধতার কবলে পড়েছে। এ কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে।
ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাঁর পদে থাকার নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাবি উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য আগামী ১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগত কর্তৃক হামলা চালানোর ঘটনায় সারা দেশে এক ধরনের ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতার ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ এনে- এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ডিন অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন সময় প্রক্টরের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানাবিধ অভিযোগের ভিত্তিতে আন্দোলনের পর গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রক্টরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা প্রতি নিয়ত ঘটছে। পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছুরি, রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দিলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, গত ১৯ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘কর্তৃপক্ষ নয়, হল চালাচ্ছে ছাত্রলীগ!’ শিরোনামে প্রতিবেদনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মীরা কীভাবে হলে সিট বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তার করছে এবং এতে প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার বিষয়টিও সামনে এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যের মতো ভয়াবহ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে গোপেন কিংবা প্রকাশ্যে।
এসব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে সরকারের ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলমান থাকলেও উপাচার্যদের অন্যায়, অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্যের লড়াই নিরসনে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্রমেই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
আর এই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণসহ অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তাঁকে সহজে পদ থেকে সরানো হয় না। সেই কারণে, তিনি (উপাচার্য) ধারণা করেন, সরকার তাঁকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নিয়োগ দিয়েছেন। আর যেহেতু সরকার তাঁকে আস্থাভাজন মনে করেই নিয়োগ দিয়েছেন কাজেই তাঁর মেয়াদ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হাজারো অনৈতিক কার্যক্রমকেও তিনি নৈতিক মনে করেন। সম্প্রতি জাবি উপাচাযর্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তিনি পরিষ্কার সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন উপরের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তিনি পদ থেকে সরবেন না। একজন উপাচার্য দীর্ঘ সময় ধরে পদে রয়েছেন, তবুও কেন তাকে নানাবিধ অন্যায়-অপকর্মকে সমর্থন করে পদে বহাল থাকার অনৈতিক চেষ্টা করতে হবে- সেটি কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশে নিজের নীতি-নৈতিকতার অবস্থান থেকে পদ থেকে সরে যাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছায় পদ থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক। কিন্তু আমাদের দেশে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো কর্ণপাত লক্ষ করা যায় না। উপরের নির্দেশ আসার অপেক্ষায় তাঁরা স্বপদে বহাল থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ অনিয়ম, অন্যায়ের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন কিংবা অনিয়মের কথাও শোনা যাচ্ছে। বহু প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মেয়াদ পূর্ণ না হওয়ার অজুহাতে তাদের পদে বসিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, যিনি নৈতিক যোগ্যতা হারাবেন, তিনি কেন পদে বহাল থাকবেন? এসব ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলেই অনিয়ম, তিনি বা তাঁরা অন্যায়ের বৈধতা পেয়ে যাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থা বিরাজ করার পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বড় কারণ হলো- উপাচার্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি না হওয়া। সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে অনেকেই উপাচার্য হচ্ছেন। যে কারণে সরকারের কাছে, মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে শুরু থেকেই খুশি করার তোষামদিতে ব্যস্ত থাকেন। আর এই খুশির বেড়াজাল সহজে কেউই ভাঙতে পারেন না।
বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক অগ্রযাত্রা থাকলেও বিভিন্ন পর্যায়ে কতিপয় তথাকথিত সরকারদলীয় তোষামোদকারী ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে যথাযথ সুশাসন বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সরকার যদি প্রকৃতপক্ষেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বর্তমানে চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’ অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু অভিযোগ কিংবা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, যথাযথ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার আগেই এসব দুর্নীতিবাজদের উৎখাত করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।