বিজয়ের এইদিনে
ভারতে বিমান হামলা, যৌথ কমান্ড বাহিনী গঠন
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩ ডিসেম্বর একটি ঘটনাবহুল দিন। এদিনেই ঘটে একের পর এক নাটকীয় কাণ্ড।
মুক্তিবাহিনীর একের পর এক আক্রমণে দিশেহারা হতে থাকে হানাদার বাহিনী।
তারা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কষতে থাকল। যার চূড়ান্ত দৃশ্য দেখা গেল পাকিস্তান কর্তৃক ভারতে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আদায় করা।
হয়তো পাকিস্তান ভেবেছিল, মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে রূপ দেওয়া গেলে জাতিসংঘের কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আনা সম্ভব হবে। জাতিসংঘ তখন উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করবে এবং উভয় দেশে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে। এতে করে পাকিস্তানি বাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে থেকে যেতে পারবে।
‘অপারেশন চেঙ্গিস খান’ নামের এ অপারেশনে পাকিস্তান ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোর্ট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উত্তরালইসহ দিল্লির কাছাকাছি আগ্রার বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। জবাবে ভারতও পাকিস্তানের ওপর পাল্টা হামলা চালায়। পাকিস্তানের এ আক্রমণ ছিল বিকেল নাগাদ।
বিকেল ৫টায় রেডিও পাকিস্তান এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রচার করে। তাতে বলা হয়, ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে।’ সংবাদ প্রচারের নয় মিনিট পর পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের দিকে রওনা দেয়। আর অমৃতসর ও পাঠানকোর্টের দিকে যায় আটটি মিরেজ বিমান। এগুলো উড়েছিল সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে। এ ছাড়া দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে পাঠানো হয় আগ্রায় আঘাত হানার জন্য। সব মিলিয়ে মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান এ আক্রমণে অংশ নেয়। মোট ১১টি স্থানে পাকিস্তান হামলা করেছিল।
এদিন বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি বিমান হামলার কথা শুনতে পান এবং তৎক্ষণাৎ দিল্লির উদ্দেশে উড্ডয়ন করেন। রাতেই মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক করেন। মধ্যরাতের কিছু পরে তিনি বেতার বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। জরুরি অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল, তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’ তিনি ভারতবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও চট্টগ্রামে ফুয়েল পাম্পে সফল আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এতে হানাদারদের অবস্থা কঠিন থেকে কঠিনের দিকে যায়।
এদিন ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী মেজর আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে কুমিল্লার মিয়াবাজার হানাদারমুক্ত করে। আখাউড়ার আজমপুর রেলস্টেশনে দুই পক্ষ দিনভর যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। সিলেটের ভানুগাছায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ১৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সুবেদার মেজর লুত্ফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এদিন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হানাদারমুক্ত করেন। এর পর চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তারা পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালান। একই দিন মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। জীবন বাঁচাতে রংপুরের পলাশবাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ১২ পাকিস্তানি সেনা। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা।
এদিনেই ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারতযুক্ত কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।
মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন গরীবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোর-ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি রুটে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
যশোর, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর জেলার আরো কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। গভীর রাতেই পূর্ণাঙ্গ লড়াই শুরু হয়। হানাদার বাহিনীর ওপর চারদিক থেকে ওপর আক্রমণ শুরু করে ভারতীয় সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী। আর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনী।
পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য, ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়। এদিন ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পাকিস্তান কর্তৃক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে। আক্রমণের প্রথমভাগেই সফলতা আসে। কমান্ড বাহিনী হানাদার বাহিনীর সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে সলিল সমাধি দিতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ জারি হয়।