বিজয়ের এইদিনে
পাল্টাপাল্টি বিমান হামলা, জাতিসংঘে উত্তেজনা
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের পাল্পাপাল্টি বিমান হামলায় পাকিস্তানের অবস্থা বেগতিক হয়। এতে নড়েচরে বসে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ৪ ডিসেম্বর তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে একটি চিঠি পাঠান।
এতে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয় আক্রমণের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবেই পাকিস্তান সীমিত আকারে বিমান হামলা চালিয়েছে। ভারতীয় আগ্রাসনের ফলে যে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন তা গোচরে নেয় এবং এক দেশের বিরুদ্ধে অন্য দেশের শক্তি প্রয়োগ বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়।
একই দিন দুপুরে ইয়াহিয়া খান আবার বেতারেও ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর মতে পাকিস্তান ভারতের অনেক অত্যাচর সহ্য করেছে। এখন সময় এসেছে এর প্রতিশোধ নেওয়ার।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘে চলে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্র এ বিমান হামলাকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দাঁড় করিয়ে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করতে উদ্ধত হয়। সিনিয়র জর্জ বুশ নিরাপত্তা পরিষদে এ দাবি উত্থাপন করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।”
আদতে কথাটি শুনতে স্বাভাবিক মনে হলেও এর শেকড় ছিল অনেক গভীরে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাব পাস হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাটা পড়ত। হানাদার বাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলার মাটিতে থাকার সুযোগ পেত। হয়তো তারা নিজেদের ঘুছিয়ে নিতে সক্ষম হতো। চীনও তাদের সাথে থাকার অঙ্গীকার করেছিল।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলার সূর্য্যসন্তানরা বসে থাকেননি। তাঁরা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে নিজেদের জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। যদিও এটা ছিল মুজিবনগর বিপ্লবী সরকারের অন্যতম কাজ। তারা যুদ্ধের প্রথম দিক থেকেই এ পথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিল।
৪ ডিসেম্বরের এ ঘটনায় নতুন করে কৌশল অবলম্বন করতে হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বরাবর পত্র লেখেন। পত্রের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা। একই পত্রে তাঁরা উল্লেখ করেন ‘আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, উভয় দেশের এই ভয়াবহ বিপদের সময় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে।’
কিন্তু খুশির খবর হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের কড়া অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তারা ভেটো প্রধান করে এটা বন্ধ করতে সক্ষম হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্টা প্রস্তাবে বলে, সবার আগে দরকার পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক সমাধান। সেই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। এটি করা হলে একদিকে যেমন সংকটের রাজনৈতিক সমাধান হবে, তেমনি যুদ্ধেরও অবসান হবে।
এই ভেটো ও প্রস্তাবের সাথে হাত মেলায় পোল্যান্ড। অন্যদিকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডও ভোটদানে বিরত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার ফলে পাকিস্তানের পরাজয় ঘণ্টা বাজতে আর বাঁধা থাকল না। যতটুকু সময়ের প্রয়োজন ছিল তা হলো অভ্যন্তরীণ শত্রুমুক্ত করার জন্য।
মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণ থেমে থাকেনি। তাদের আক্রমণে সমগ্র বাংলায় হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে।
একাত্তরের এই দিনে ৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শমশেরনগর বিমানবন্দর এবং আখাউড়া রেলস্টেশন দখল করেন।
৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল সি আর দত্ত এবং জেড ফোর্সের নেতৃত্বে পাক হানাদারমুক্ত হয় সিলেটের কানাইঘাট
৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মেহেরপুর দখল করে যশোরের দিকে রওনা হন।
এ ছাড়া ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে কামালপুর বিওপি নিজেদের আয়ত্তে আনেন। যা ছিল হানাদার বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি।
এইদিন নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরের মতলব, কুমিল্লার দেবিদ্বার, শেরপুরের ঝিনাইগাতী ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর হানাদারমুক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। হানাদারদের অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এসব এলাকায় পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী ঘুড়ে দাঁড়াবার নানা কৌশল অবলম্বন করে। তারা দিনাজপুরের ফুলবাড়ী রেলস্টেশন দখলে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে।
এদিকে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাবমেরিন পিএনএস গাজী বিশাখাপত্তম বন্দরের কাছে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো ঢাকা, চট্টগ্রমসহ বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর সামরিক ঘাঁটির ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালায়। এ সময় ঢাকায় পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটিতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন জঙ্গি বিমান (২৮টি), ১৪টি চায়না মিগ-১৯ বিমান আর ১৪টি মার্কিন স্যাবার জেট।
প্রথম রাতের আক্রমণেই পাক দখলদার বাহিনীর জঙ্গি বিমানবহরের প্রায় অর্ধেক অকেজো হয়ে পড়ে।
সর্বোপরি এই দিনে পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে চলে আসে।