বিজয়ের এই দিনে
বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা
এদিন ২৪ ঘণ্টার কারফিউ অব্যাহত থাকে। চলে ঘরে ঘরে তল্লাশি। সঙ্গত কারণেই এদিন কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি।
এদিন রাতে ঢাকা সেনানিবাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা কষতে রাজাকারদের সাথে বসে প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। রাও ফরমান রাজাকারদের হাতে তুলে দেন দেশের সূর্য সন্তানদের নাম । চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় রাতেই আলবদর বাহিনী সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে তাঁদের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। তাঁরা আর ফিরে আসেননি।
এদিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি তাঁর দলের সদস্য এবং সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, মুক্তিসংগ্রামে জয়লাভের আর দেরি নেই।
এদিকে ১১ ডিসেম্বর রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তা আজকের এই দিনেই ব্যর্থ হয়ে যায়। কিসিঞ্জারের হুঁশিয়ারিটি ছিল আগামীকাল (১২ ডিসেম্বর) দুপুরের মধ্যে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করাতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
তবে ১২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত-পাকিস্তান প্রতিনিধির দীর্ঘ বক্তব্যের পর অধিবেশনটি মুলতবি হয়ে যায়।
অন্যদিকে ৯ ডিসেম্বর রওনা দেওয়া ৭ম নৌবহর আজকের এই দিন বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থান নেয়।
এদিকে এই নৌবহরের তৎপরতা বিঘিœত করার জন্য যৌথ বাহিনী বিভিন্ন কৌশল হাতে নেয়। কৌশলের ধারাবাহিকতায় তারা চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট-বড় অবশিষ্ট সব জাহাজ ও নৌযান, উপকূলীয় অবকাঠামো, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রভৃতি অকেজো বা ধ্বংস করে ফেলে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আহ্বানের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টকে এক বার্তা পাঠান। যাতে তিনি বলেন, ‘ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে, একমাত্র যদি পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছাতে সম্মত হয়।’
এদিকে, পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।’
এদিন চার নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিবাহিনী হরিপুর আক্রমণ করে এবং পরের দিন হরিপুর শত্রুমুক্ত হয়। নীলফামারী, গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ী, ভেড়ামারা ও শ্রীপুর শত্রুমুক্ত হয়।
দিনাজপুরের বিরল থানার বহলা গ্রামে আজকের এই দিনে চলে এক নৃশংস গণহত্যার ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী ওই গ্রামটিতে ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা গ্রামবাসীকে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেয়। পরে আবার তারা গ্রামবাসীকে একত্রিত করে। ঠিক সন্ধ্যার সময় ঘটে এ হত্যাকাণ্ড। যখন মুসল্লিরা মাগরিবের নামাজ আদায় করছিল। এসময় হানাদার বাহিনী পেছন দিক থেকে ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলে ৩৭ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
একই দিন দিনাজপুরের খানসামা থানা আক্রমণ করে যৌথবাহিনী। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৫ জন ও সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের হাতে পাকবাহিনীর এক মেজরসহ ১৯ জন ধরা পড়ে।
সন্ধ্যার আগেই জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর রাতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।
তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী। পক্ষ-বিপক্ষ তুমুল লড়াইয়ের ফলে ঢাকা অভিযানের পথ আরো মসৃণ হয়। ভোররাতের দিকে হানাদাররা পরাস্ত হয়।