বেতন কাঠামো
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো ও আমলাতন্ত্র
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ডক্টর শাহাদুজ্জামান তাঁর ‘একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়’ বইতে লিখেছেন, নিজেকে অন্যের চেয়ে ক্ষমতাশালী প্রমাণ করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সব সময়ই কাজ করে। তিনি বলেন, দুজন অপরিচিত ব্যক্তির প্রথম পরিচয় ও আলাপচারিতায়ই সেটা ফুটে ওঠে। অষ্টম বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের পুরোনো দাবি স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের বিষয়টি আবার আলোচনায় এলে অর্থমন্ত্রী সে বিষয়ে যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে ভরা মন্তব্য করে চলেছেন, তাঁর ব্যাখ্যায় বিষয়টি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। মূল আলোচনাটি বিখ্যাত ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী হেনরি সামার মেইনের ‘অ্যান্সিয়েন্ট ল’ বইয়ের তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে শুরু করতে চাই। ওই বইতে সমাজ ও আইনের বিবর্তন ব্যাখ্যায় তিনি ‘আদিম’ সমাজকে ‘স্ট্যাটাস সোসাইটি’ বলে অভিহিত করেন। ওই সমাজের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচরণে ব্যক্তিগত স্ট্যাটাস প্রদর্শনের নিরন্তর একটা চেষ্টা লক্ষ করা যেত। অন্যদিকে তিনি পশ্চিমা ‘আধুনিক’ সমাজকে বলেন ‘কনট্রাক্ট সোসাইটি’, অর্থাৎ এখানে ব্যক্তির পরিচয় স্ট্যাটাস-নির্ভর নয়, কাজনির্ভর; ব্যক্তি এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন, যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, সংগঠন করতে পারে, চুক্তিবদ্ধ হতে পারে।
এই তাত্ত্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোকে ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায়, আমরা এখনো উন্নত বিশ্বের চেয়ে শতসহস্র বছর পেছনে রয়ে গেছি। স্তরায়িত আমাদের এই সমাজে আজো জন্মই সামাজিক মর্যাদার পরিচায়ক। জন্মের পর নামের সঙ্গে চৌধুরী, মিঞা, ভূঁইয়া ইত্যাদি উপাধি সংযোজনের মধ্য দিয়েই আমাদের পথচলা শুরু হয়। আমাদের চিন্তা ও কর্মের এই প্রতিফলন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে দেখা যায়।
ব্রিটিশরা সামাজিক স্তরায়ন ও শোষণকে পাকাপোক্ত করার জন্য এ দেশে আমলাতন্ত্র সৃষ্টির মাধ্যমে আসলে একটা জনবিচ্ছিন্ন অভিজাত শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল; সে ধারাবাহিকতা আজো বিদ্যমান। এই পেশার প্রশিক্ষকরা সদ্য যোগদানকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিখিয়ে তোলেন যে তাঁরা হলেন জনগণের প্রভু। ফলে চাকরির বয়সকাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রভুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং চিন্তায় ও মননে তাঁদের বেশির ভাগই আর সাধারণের কাতারে আসতে পারেন না। তাঁরা বেমালুম ভুলে যান যে তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক। আমলাতন্ত্রের প্রভুত্ব আরোপ আজ আর শুধু সাধারণ জনগণের ওপরেই সীমাবদ্ধ নয়, ধীরে ধীরে ডালপালা ছড়িয়ে তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে গ্রাস করার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। আমলাদের পক্ষে এত কিছু সম্ভব হয়েছে রাজনীতিবিদদের আমলা তোষণনীতির কারণে। এই আমলারা যুগে যুগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণ হয়েছে। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে উপেক্ষা করে রাজনীতিবিদরা আমলাদের পক্ষে কাজ করে গেছেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেও সে বিষয়টি পরিষ্কার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল সম্পর্কে মন্ত্রীর নেতিবাচক বক্তব্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থের অভাবে নয়। সব পেশার মানুষকে একটা একক বেতন স্কেলের আওয়ায় রেখে আমলাতন্ত্রকে আকাশের সীমানায় ধরে রাখার জন্য।
এ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে নিয়ে বরাবরই উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহার এবং পাঁচ বছর আগে প্রণয়ন করা শিক্ষানীতি মানুষকে আশান্বিত করেছিল। ২০১০ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত এই জাতীয় শিক্ষানীতিতে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করার কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন অপরিহার্য হলেও আমলাতান্ত্রিক অসহযোগিতার কারণে বিষয়টি আর এগোয়নি। আইন না হলে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনোটিই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এর আগের সরকারগুলো শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে চূড়ান্ত বা বাস্তবায়ন শুরুর আগেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নে লম্বা সময় পেয়েছে বর্তমান সরকার। কিন্তু এখানেও সে একই পুরোনো সমস্যা।
স্বতন্ত্র বেতন স্কেল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, যে বেতন স্কেল দেওয়া হয়েছে, তাতে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সাবেক এই আমলা এটাও নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, বর্তমান বেতন স্কেলে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২৬ ক্যাডারসহ পরিকল্পিতভাবে দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অপমান করা হয়েছে; আমলাতন্ত্রকে চিরস্থায়ীভাবে প্রভুর আসনে বসানোর কূটকৌশল চালানো হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা যে এখনো ‘আদিম’ তথা সামন্তবাদী অবস্থা থেকে বের হতে পারিনি, আমলাদের অন্য সবার চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও মর্যাদাবান বানানোর এই আয়োজন তার প্রমাণ। অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো একটি খাতে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দেওয়া হলে অন্যরাও একই দাবিতে চাপ সৃষ্টি করবে। সেসব দাবি মেনে নেওয়া হলে দেখা যাবে সচিবদের চেয়ে মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের বেতন বেশি হয়ে গেছে। তাতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কিন্তু যারা স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি করে আসছে, তারা কেউই সচিবদের অধীনে চাকরি করে না। তাই মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের বেতন বেশি হওয়ার প্রশ্নটি এখানে অবান্তর। এখন প্রশ্ন হলো, সচিবকে কেন্দ্রে রেখে বেতন ও মর্যাদা নির্ধারণের এ রাষ্ট্রীয় আয়োজন কেন? বাস্তবে বেতন কাঠামো এক হলেও সবার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কি এক? রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন যদি আলাদা হয়, তাহলে বেতন কাঠামো আলাদা হলে সমস্যা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সচিবালয় এগুলোর কারো সাথে কারো কাজের তুলনা চলে না। তাই এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সর্বোচ্চ সেবা আদায় করার স্বার্থে এদের বেতন কাঠামো আলাদা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশেই শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল এবং শিক্ষকদের বেতন আমলাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আর উন্নত বিশ্বের কোথাও আমলা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন স্কেল এক নয়। তাহলে বাংলাদেশ কোন যুক্তিতে যুগ যুগ ধরে শিক্ষক সমাজকে বঞ্চিত করে আসছে? বাস্তবায়ন না করলে কেনই বা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ইশতেহার ও শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের অঙ্গীকার করেছিল? আমরা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনুকূল শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবি না। এ কেমন স্বপ্ন দেখা?
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তালিন বিশ্ববিদ্যালয়, এস্তোনিয়া।