অশ্লীলতার সংজ্ঞা আর বই নিষিদ্ধের অশ্লীলতা
নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আমার আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। মানুষ মাত্রেই তাই। লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখনই বললেন, ‘বইটি পড়বেন না’, আমি ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক, বইটা আমার পড়তেই হবে। বই তো নিষিদ্ধ। এ বই ক্যামনে এক কপি জোগাড় করে সংগ্রহে রাখব, এই আমার বর্তমান চিন্তা।
যা হোক, বইয়ের কয়েক লাইন আমাদের বাংলা একাডেমির ডিজি সাহেব জাফর স্যারকে পাঠ করে শুনিয়েছেন। সেই কয়েক লাইন শুনেই স্যারের মনে হয়েছে বইটি অশালীন। এ বই যেন আমরা না পড়ি, এমন উপদেশও তিনি দিয়ে ফেলেছেন। এখন কে কী বই পড়বে না-পড়বে, তা ঠিক করে দেওয়া হবে, এ তো ভালো কথা। শিশুকালে আমি এমন শিক্ষক পাইনি। ফলে বুদ্ধদেবের ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ থেকে শুরু করে সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ ক্লাস নাইনে ওঠার আগেই বাথরুমে বসে পড়ে ফেলেছি। তাতে অবশ্য আমার কী ক্ষতি বৃদ্ধি হয়েছে, জানি না।
ক্লাস নাইনে থাকতে আমি আরো যেসব বই পড়েছি, তার মধ্যে মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’, হুমায়ূন আজাদের ‘নারী’, অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমি সর্বভূক, যা পেতাম, তাই পড়তাম। কিছু না পেলে ঠোঙ্গা খুলে পড়তাম। তো, এ অবস্থায় আমারে কেউ বলে দেয়নি, কোনটা অশ্লীল। আমি এত ধরনের বই পাঠ করেছি যে আমার বিবেক-বুদ্ধি-রুচি একটা পরিমিত ব্যালান্স রেখে তৈরি হয়ে যায় বলে আমি নিজেই প্রকৃত অশ্লীলতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। ফলে একটা সময়, যা শুধু অশ্লীল, অর্থাৎ অশ্লীলতা ছাড়া যে বইটির আর কোনো সম্পদ নেই, তাকে আমি নিজেই অনায়াসে বর্জন করেছি। আমাকে আমার বাবা-মা-বড় বোন-ভাই-শিক্ষক কেউ এসে বলেনি, এই বই পড়ো না।
আমাদের ছেলেবেলায় কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ আর সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার লিখে যে মানুষটা আমার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জয় করে নিয়েছেন, তার নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বড় হয়ে দেখেছি, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি পাশে আছেন। তিনি তারুণ্যের পাশে আছেন, মুক্তচিন্তা আর প্রগতির পাশে আছেন। এই অবস্থায় অকস্মাৎ তাঁর মুখে থেকে অশ্লীলতাবিষয়ক এই বাণী আমার হৃদয়রাজ্যে চরম আঘাত বলা যেতে পারে।
আমি স্যারের কাছে শুধু একটা অনুরোধই করতে পারি, তিনি যেন ‘অশ্লীলতা’র প্রকৃত সংজ্ঞা আমাদের দেন।
গত বছর বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ হলো। অভিজিৎ রায় খুন হলেন বইমেলা প্রাঙ্গণে। জাগৃতির দীপন খুন হলেন। টুটুল, তারেক, রণদীপমকে কোপানো হলো। এ বছর খেলাফত আর শিবিরের উসকানিতে বন্ধ হলো শামসুজ্জোহা মানিকের ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল, নিষিদ্ধ করা হলো ইসলাম বিতর্ক নামের বইটি।
ব-দ্বীপের স্টল বন্ধ হওয়ার পর দেশের সুশীল সমাজ, জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী টুঁ শব্দ করলেন না। কারো কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ দেখলাম না। হাতে হাতকড়া পরিয়ে কোর্টে তোলা হলো শামসুজ্জোহা মানিকের মতো লেখক, গবেষককে।
আর আজ ডিজি সাহেবের পাঠ শুনে বই নিয়ে এমন অদ্ভুত মধ্যযুগীয় বক্তব্য শুনলাম প্রিয় লেখক জাফর ইকবালের কাছ থেকে। তিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে নিষেধ করেছেন। স্যার কি মনে করেন, ভিন্নমত প্রকাশের পথ বন্ধ করে দিয়ে একটি অবরুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে এমন কোনো জাতি গঠন সম্ভব হবে, যারা আধুনিক ও মুক্তমনের অধিকারী হবে?
জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ড. জাফর ইকবাল স্যারের কাছে আমার অনুরোধ, তিনি যেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রকৃত সংজ্ঞা ও এটি নিরূপণের উপায়গুলোও আমাদের বলে দেন, ঠিক যে রকম অশ্লীলতার একটি সঠিক সংজ্ঞা আমাদের প্রয়োজন এ মুহূর্তে।
হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ লেখার পর অশ্লীলতার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ‘নারী’ বইটি প্রকাশের পর অশ্লীলতার অভিযোগ তোলা হয়েছিল এবং নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তসলিমা নাসরিনের ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ প্রকাশের পর অশ্লীলতার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এবং এই তিনটি বই-ই আমার পড়া সেরা বইগুলোর অন্যতম।
যে অশ্লীলতাকে আপনারা নির্ধারণ করেন, তা কোন দাড়িপাল্লায় তা আমার জানতে হবে। কেননা, আপনারা আমাকে মানা করছেন অশ্লীল বই পড়তে। কিন্তু আমি জানি না, আপনার অশ্লীলতার সংজ্ঞা আমার সংজ্ঞার সঙ্গে মেলে কী না। এবং আপনি আজ যা অশ্লীল বলছেন, কয়েক যুগ পরে তা অশ্লীল নাও হতে পারে। কিংবা আজ যা আপনি রুদ্ধ করতে চাইছেন, সেই দ্বার খুলে গেলে কোনো একদিন আপনাকেও দাঁড়াতে হতে পারে কাঠগড়ায়।
বই প্রকাশের দায়ে প্রকাশক-লেখককে হেনস্তা করার যে প্রক্রিয়া চলছে, সেই প্রক্রিয়ায় আজ আপনিও অংশীদার হয়েছেন, এটাই আমার কষ্টের জায়গা। কেননা, ওই যে কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, ওই যে বুগাবুগা, ওই যে নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর সেই জাফর ইকবাল আপনি; যিনি সহকর্মী শিক্ষকদের অপমানের প্রতিবাদ জানাতে বৃষ্টির ভেতরে স্তব্ধ বসে থাকেন ঠায়, যিনি পাকিস্তান আর জামায়াত-শিবিরের উদ্দেশ্যে ঘৃণাময় ‘না’ ছুড়ে দিতে পারেন অনায়াসে, যিনি শিশুদের জন্য একটি আধুনিক সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখান। আপনি সেইজন।
জানি না, আপনারা কখন কী ভাবেন, আর কী চান। তবে আমরা, এই প্রজন্ম যারা মুক্তবুদ্ধি আর আধুনিক সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখি, তারা লেখকের স্বাধীনতা চাই। আমরা সবকিছু পড়ে দেখে নিজেই যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে চাই, কোনটা রাখব আর কোনটা বর্জন করব। আমরা একটি সুন্দর বইমেলা চাই, যেখানে কখনো কোন বই নিষিদ্ধ, আর স্টল বন্ধের মতো ‘অশ্লীল’ ঘটনা ঘটবে না।
লেখক : সাংবাদিক