সাক্ষাৎকার
যুদ্ধবিদ্যাটা আমার আগেই জানা ছিল : শাহজাহান সিদ্দিকী, বীরবিক্রম

শাহজাহান সিদ্দিকী বীরবিক্রমের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সাতমোড়া গ্রামে। ১৯৬৫ সালে মুরাদনগর থানার শ্রীকাইল কৃষ্ণকুমার স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৭ সালে শ্রীকাইল কলেজ থেকেই এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে তিনি সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ইউটিসির আওতায় সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে গিয়ে অন্যান্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্পেশাল নৌ-কমান্ডো ট্রেনিং-এ অংশ নেন। একমাত্র বেসামরিক নৌ-কমান্ডো লিডার হিসেবে আগস্টে অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটে অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হলে সফল অপারেশনের জন্য বীরবিক্রম খেতাব পান। পরে ১৯৭৩ সালে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি নেন। দায়িত্ব পালন করেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক হিসেবে। কূটনেতিক সদস্য হিসেবে কাজ করেন দুবাইয়ে। পরে সচিব হিসেবে অবসরে যান ২০০৭ সালে। এরপর দায়িত্ব পালন করেন (ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি) ডেসকোর চেয়ারম্যান হিসেবে। বর্তমান অবসর জীপনযাপন করলেও লেখালেখি ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখনো কর্মমুখর শাহজাহান সিদ্দিকী। তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর।
বাশার খান : ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
শাহজাহান সিদ্দিকী : আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র। তখন এর নাম ছিল ঢাকা হল। আমার আপন ভাই, আমার জেঠাতো ভাই মিজানুর রহমান, আমার ভাগিনা আবুল কালাম আজাদ, আজাদ নামে আমার এক মামা ও আমাদের গ্রামের আব্দুল হাকিম- আমরা একই হলে থাকতাম। ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা গ্রামে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে- এটা বুঝে গেছি ততদিনে। আমাদের গ্রামের কালীবাড়ি মাঠে এলাকার তরুণদের নিয়ে বাঁশ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ১৯৬৮ সালেই আমার মিলিটারি সায়েন্স কোর্স করা ছিল। যুদ্ধবিদ্যা আমি ভালোই জানতাম।
বাশার খান : অন্যদেরকে ট্রেনিং দেওয়ার মতো সামরিক বিদ্যা কি আপনার রপ্ত ছিল ?
শাহজাহান সিদ্দিকী : হ্যাঁ। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি শারীরিক শিক্ষা ক্লাসেও প্রশিক্ষণ নেই। এরপর ‘ইউনিভার্সিটি অফিসার ট্রেনিং কোর্স’ বর্তমানে যা বিএনসিসি কোর্স নামে পরিচিত- তাতে অংশ নেই। এই ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে ‘জুনিয়র মিলিটারি সায়েন্স’ বিষয়ে ফিল্ড ট্রেনিংয়ের জন্য আমাকে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। ওখানে তাবু টানানো, সেন্ট্রি ডিউটি, নাইট মার্চ, ম্যাচ রিডিং, পাস ওয়ার্ড, হ্যাভার স্যাক নিয়ে রোড মার্চ এবং রাতে নিঃশব্দে চলাচলে নানা কায়দা-কানুন শিখি। এখান থেকেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান ও এলএমজি চালানো বিদ্যা রপ্ত করি।
বাশার খান : আচ্ছা, এবার ২৫ মার্চের ঘটনায় আসা যাক।
শাহজাহান সিদ্দিকী : এর মধ্যে ২৩ মার্চ আমি ও আমার জেঠাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান আমার ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। ২৬ মার্চ সকালে খাওয়া-দাওয়া করে আমার বোনের বাড়ি সীমন্তঘরের দিকে রওয়ানা হলাম। পথে দেখলাম বহু নারী-পুরুষ গাট্টি নিয়ে ঢাকা থেকে আসছে। শরণার্থীদের মতোই অবস্থা। তখনই জানলাম- আগের রাতে ঢাকা আক্রমণ হয়েছে। বহু লোককে হত্যা করেছে। তখন যে যেভাবে পেরেছে গ্রামের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে। তাদের মাধ্যমেই সংবাদটা পেলাম।
বাশার খান : মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?
শাহজাহান সিদ্দিকী : সেদিনই আমরা ঢাকায় আক্রমণের প্রতিবাদে মিছিল করলাম। পরে সেখানে আমাদের প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি মেম্বার ছিলেন আহমদ আলী সাহেব, আওয়ামী লীগের কুমিল্লা জেলা সভাপতি, উনি এলেন। আমাদের দেখলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। যেতে হবে আগরতলা। তখন গ্রামে ফিরে এলাম। নবীনগরে গেলাম বিস্তারিত খোঁজ নিতে। তখন তো মোবাইল ছিল না। নিজে গিয়ে বা কাউকে পাঠিয়ে খোঁজ নিতে হতো। সেখানে গিয়েই শুনলাম আব্দুল কুদ্দুস মাখন আসবে। কিছুক্ষণ পরই লঞ্চে করে তিনি এলেন। লঞ্চঘাটে স্থানীয় জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন। বললেন, ‘ঢাকায় নিরীহ মা-বোনদের ওপর অতর্কিত হামলা শুরু হয়েছে। শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হবে, স্বাধীন করতে হবে দেশকে।’ বাড়ি এলাম সেদিন। এরপর আমি যাদেরকে ট্রেনিং দিতে শুরু করেছিলাম- তাদেরকে নিয়ে ২২-২৫ জন একত্রিত হলাম। আমাদের গ্রামের রফিকুল ইসলাম চাচা বিমানবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। ওনার দুটি রিভলবার ছিল। তাঁর ছেলে খোকাসহ আমরা রাতে অন্ধকারে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।
বাশার খান : রাতে গেলেন কেন ?
শাহজাহান সিদ্দিকী : মা-বাবা আবেগের বশবর্তী হয়ে বাধা দিতে পারে- এ জন্য রাতে গেলাম। গোয়ালি গ্রামে গিয়ে রাত্রিযাপন করলাম। এরপর কুমিল্লা-ময়নামতি রোড তখনকার সিএমডি রোড এটা। সেটা ক্রস করে সীমান্ত পার হলাম। টিলা বেয়ে এক জায়গায় গেলাম। জানতে পারলাম- জায়গাটার নাম মধুপুর। স্থানীয়দের বললাম, আমরা জয় বাংলা থেকে এসেছি। আমরা যুদ্ধ করব। এপ্রিলের শুরুতে এ ঘটনা। আমাদের একটা ছনের ঘরে থাকতে দিল স্থানীয় কিছু লোক। আমাদের সঙ্গে কিছু টাকা-পয়সা ছিল। এক মুসলমান ভদ্রলোক তাঁর বাড়ি থেকে রান্না করে এনে আমাদের খাওয়াতেন। খোঁজ নিতে থাকলাম- কোথায় গেলে সঠিক প্রশিক্ষণ পাবোৱ। এভাবে যুদ্ধ অংশ নেই।
বাশার খান : এবার একটু পেছনে ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
শাহজাহান সিদ্দিকী : আমি রেসকোর্স ময়দানে ছিলাম। ঢাকা হলের অনেক ছাত্রই উপস্থিত ছিলাম। ৭ মার্চেও ভাষণে অংশগ্রহণ নিয়ে গৌরব বোধ করি। আগে থেকেই শুনছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিও- টেলিভিশনে প্রচার করা হবে না। এ নিয়ে আমরা খুব উত্তেজিত ছিলাম। ডাইনিংয়ের দোতলায় কমনরুমে একটা টিভি ছিল। সেখানে আমরা উত্তেজনা নিয়ে রাতে বসে আছি। হঠাৎ দেখি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হচ্ছে। সেদিন রাতে ভাষণ প্রচার হয়।
বাশার খান : আপনি কোথায়-কীভাবে প্রশিক্ষণ নিলেন?
শাহজাহান সিদ্দিকী : আমি ছেলেবেলা থেকে দুর্বার-দুরন্ত ছিলাম। সাঁতার, গোল্লাছুটসহ অন্যান্য সব খেলাধুলায়ই পটু ছিলাম। সমবয়সীরা আমার সঙ্গে পেরে উঠত না। এলাকার মুরুব্বিদের কাছে যুদ্ধকাহিনী শুনলেই কেন যেন আন্দোলিত হতাম। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যে যুদ্ধ হলো- গ্রামের রহমান ভাই এটা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করতেন। আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। এলাকার মিলন চাচা সিপাহি ছিলেন। যুদ্ধে অংশ নেন। উনি কাহিনী শোনাতেন। আমি উত্তেজিত হতাম। মন চাইত যে এখুনি যুদ্ধে যাই। আমার এক ফুফাতো ভাই আমাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। এরপর উনি চট্টগ্রামে থাকতেন। ওনার ওখানে যাইতাম। সেখানে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। যুদ্ধের সিনেমাই বেশি দেখতাম। ইংরেজি যুদ্ধের ছবি ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। বিমান আক্রমণ, গোলাগুলি- এগুলো ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। সৈন্য হওয়ার ইচ্ছা ছিল তখন থেকেই। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম যখন, তোফায়েল আহমেদ সাহেব আমার বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আমি ওনার অনুসারী ছিলাম। নূরে আলম সিদ্দিকী তখন জেলে। ওনাদের সঙ্গে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া আর হলো না। কিন্তু সামরিক বিদ্যা শেখার বিষয়টি সব সময় মাথায় ছিল। নেতারাও বললেন, যে যেভাবে পারো সামরিক প্রশিক্ষণ নাও। তখন ইউটিসি ট্রেনিং নিলাম। যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। ভারত যাওয়ার আগেই যুদ্ধবিদ্যাটা আমার জানা ছিল। তো ভারতে গিয়ে মধুপুরে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ করে দেখি, একটা আর্মির জিপগাড়ি। স্থানীয়রা বলল- এখানে জয় বাংলার লোক আছে। জিপটা আমাদের কাছে এসে থামল। একজন নেমে পরিচয় দিলেন- আমি ক্যাপ্টেন হায়দার। তিনি বললেন, তোমরা আর চার-পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে আসো- সেখানে মিলিটারি ক্যাম্প আছে। আমরা গেলাম। আমাকে বলল, তুমি যেহেতু মিলিটারি সায়েন্স কোর্স পাস করা- তাহলে এই ম্যাপ রিডিং করে দেখাও। বাকি ইয়াংদের ট্রেনিংয়ের জন্য নিয়ে গেল- শালবন বিহার। চার দিন পর আমাকেও শালবন বিহারে নিয়ে গেল। সেখানে আমাদের হ্যান্ড গ্রেনেড থ্রো করা শেখানো শুরু হলো। জীবনে এই প্রথম হ্যান্ড গ্রেনেড হাতে নিলাম। মেজর শওকত (পরে মেজর জেনারেল) ছিলেন সেখানে। রাতে বনে ইট বিছিয়ে থাকতাম। কী শেখাল? গ্রামে গোবর রাখার জন্য গর্ত করে না? এ রকম একটা গর্ত করা হলো। এইচ ই থার্টি সিক্স অর্থাৎ হাই এক্সপ্লসিভ গ্রেনেড আনা হলো। আর থার্টি সিক্স মানে এটা বিস্ফোরণ হলে ৩৬টি স্প্লিন্টার বের হয়ে যায়। কীভাবে ছুড়ে মারতে হবে, সেফটি পিন খোলা, লিভারটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চেপে ধরে রাখা- এগুলো শেখাল। আমাদের বলা হলো- তোমরা দেশের ভেতরে গিয়ে শত্রুকে লক্ষ্য করে এই গ্রেনেড থ্র করবে।
বাশার খান : ১৫ আগস্ট সারা দেশে নৌবন্দরগুলোতে একযোগে আক্রমণের পর যৌক্তিকভাবে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের ব্যাপারে তো পাকবাহিনীর বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা। আপনারা পরদিন রাতে সেখানে আক্রমণ করলেন। বিনা বাধায় সফল হলেন? তাহলে ফেরিঘাটটি কি পাকবাহিনী অরক্ষিত রেখেছিল?
শাহজাহান সিদ্দিকী : খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নটি করার জন্য ধন্যবাদ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তো ১৫ আগস্ট রাতে অপারেশন করতে পারলাম না। আমাদের গাইড আবুল কাশেম প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে নেমে যেতে চাইল। আমরা তো নৌ-কমান্ডো। তিন মাস পানিতেই ছিলাম। ঝড়-বৃষ্টিতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। গাইড আবুল কাশেম অসুস্থ হয়ে পড়ায় নৌকা থেকে নেমে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু সামরিক কৌশল অনুযায়ী তো তাকে নামানো যাবেই না। তাহলে আমাদের বিপদ হবে। আমরা মাইনসহ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চারদিক জানাজানি হয়ে যাবে যে আমরা অপারেশন করতে যাচ্ছিলাম। এটা অত্যন্ত গোপনীয় অপারেশন ছিল। এই অপারেশনের কথা বাঙালিদের মধ্যে শুধু অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানী ও বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার সাহেব জানতেন। এর বাইরে কেউ জানত না। কাশেমকে ছাড়া যাচ্ছিল না যে আমাদের আরো টিম একই সময়ে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মংলায় গেছে। একটা ধরা পড়লে স্বাভাবিক কারণে অন্য কমান্ডো দলগুলোও ধরা পড়ে যাবে। তো কমান্ডার হিসেবে আমার কাছে একটাই পথ খোলা আছে যে গাইড কাশেমকে আমাদের কমান্ডো নাইফ দিয়ে হত্যা করে ফেলে অপারেশনে যাওয়া। যদিও আমার সঙ্গে ফল্ডিং করা স্টেনগান ছিল। সেটা দিয়ে গুলি করলে তো শব্দ হবে। এমন করতে করতে রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। পূবাকাশে সুবেহ সাদেক উঁকি দিচ্ছে মনে হচ্ছে। আমার সঙ্গে থাকা ডেপুটি কমান্ডো লিডার মতি- মতিউর রহমান (পরে বীরপ্রতীক খেতাব পায়) বলল, স্যার আজকে অপারেশন না করলেই ভালো হয়। মতি কিন্তু তোমাদের দাউদকান্দিরই লোক। অত্যন্ত সাহসী ছিল সে। সে বেবিট্যাক্সির ড্রাইভার থেকে নৌ-কমান্ডো হয়। তার পরামর্শ বিস্তারিত বিবেচনা করে সেদিন অপারেশন করা থেকে আমরা বিরত থাকি।
আর অরক্ষিত রাখার বিষয়ে দুটি বিষয় ছিল : ১৫ আগস্ট চাঁদপুর ও অন্যান্য জায়গায় নদীবন্দর ছিল। তারা নদীবন্দরগুলোতে সতর্ক হয়। দাউদকান্দিতে কোনো বন্দর ছিল না। এটা ছিল লঞ্চ ও ফেরিঘাট। অপর বিষয়টি হলো- পাকিস্তানি বাহিনী নিরাপত্তা জোরদার করে ফেরিঘাটের পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিককে টার্গেট করে। কারণ পূর্বদিকে রাস্তা। যেটা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত গেছে। পশ্চিম দিকে ঢাকার রাস্তা। ওই দিকে গজারিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ। আক্রমণ হলেই ওই দিক থেকে হতে পারে- এমন ধারণাই ছিল তাদের। কিন্তু উত্তর দিকে তো নদী আর চর। লোকজন নেই। ওই দিকে থেকে কেউ আসার সম্ভাবনাও নেই। তাই তারা উত্তর দিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। আমরা যে উত্তর দিক থেকে এসেই অপারেশন করব- এটা পাকবাহিনী বুঝতেই পারেনি। উত্তরদিকে যে কজন পাহারায় ছিল- তাদেরকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হই।
বাশার খান : পাহারারত সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিলেন কী করে? এতে তো বড় ধরনের ঝুঁকি ছিল?
শাহজাহান সিদ্দিকী : তারা যখন টর্চ ঘুরাত, আমরা তখন পানিতে নিঃশব্দে ডুব দিতাম। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় নদীতে স্রোত ও ঢেউ ছিল। গার্ডরা বুঝতেই পারেনি যে পানিতে ডুবে কেউ আসছে। আমরা বড় নৌকাটি দূরে রেখে ছোট আরেকটি নৌকায় এগিয়ে আসি। আমাদের সুবিধাজনক জায়গায় এসে তিনজন তিনজন করে পানিতে নামি।
বাশার খান : কেউ সাঁতরাচ্ছে- পাকবাহিনী টর্চ মেরেও বুঝতে পারেনি?
শাহজাহান সিদ্দিকী : আমাদের সাঁতার তো সাধারণ মানুষের মতো না। নৌ-কমান্ডোদের সাঁতার হাতে নয়- পায়ে। হাত দুটো থাকবে ফ্রি। শুধু নাকটি পানির ওপর থাকবে। টেলিভিশনে যেমন দেখা যায়, ডুবুরিরা এক ধরনের লম্বা জুতার মতো পরে পানিতে নামে। পায়ে যে পরে- ওটাকে বলে ফিন্স। ওটা পায়ে দিলে স্বাভাবিক সাঁতারের চেয়ে তিনগুণ বেশি গতিতে সাঁতরানো যায়। ব্যাকস্ট্রোকে সাঁতার কাটতাম। অর্থাৎ উল্টা পেছনের দিকে সাঁতার। পলাশীতে আমাদের কঠোর প্রশিক্ষণ হওয়ায় সাত-আট কিলোমিটার এভাবে সাঁতার কাটা আামাদের জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। সেই অপারেশনে ব্যবহৃত আমার ফিন্স দুটো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে দিয়েছি। তো সে রাতে প্রচুর স্রোত ছিল। প্রায়ই কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল। তো আমরা নাকটা জাগিয়ে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ভেসে যাওয়ার মতোই যাচ্ছিলাম। রাতের অন্ধকারে শত্রু পাহারাদাররা বুঝতেই পারেনি যে- কচুরিপানার নিচে মানুষ আছে। এমনি করে টার্গেট পয়েন্টে পৌঁছে যাই। ২০ গজ দূরত্বে এসে ডুব সাঁতার দিয়ে ফেরির কাছে আসি। যেন পাহারাদার বুঝতে না পারে। পানির নিচে ফেরির বডিতে যখন আমরা চলে আসি- তখন আমরা নিরাপদ। ফেরির ওপরের লোকজন আমাদের আর দেখছিল না। স্বাভাবিক কারণেই তাদের দৃষ্টি ছিল খানিক দূরে। এরপর শুরু হলো মাইন ফিট করার কাজ।
ফেরি বা জাহাজের লোহার বডিতে মাইন সহজে ফিট করার জন্য মাইনের ওপর চুম্বক ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল যে, ফেরি দীর্ঘদিন পানিতে থাকায় নিচে শ্যাওলার আস্তরণ জমে ছিল। শ্যাওলা পরিষ্কারের জন্য আগে থেকেই আমাদের কমান্ডো নাইফ দিয়ে দেওয়া হয়। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে ডুব দিয়ে আমরা শ্যাওলা পরিষ্কার করতে থাকি। কয়েকবারে শ্যাওলা পরিষ্কার সম্পন্ন হয়। পাঁচ কেজি ওজনের লিম্পপেড মাইন তো বুকের সঙ্গে বাঁধা। ডুব দিয়ে গিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে মাইন ফিট করি। মাইন ফিট করতে গিয়ে শব্দ না করার কৌশল আমাদের আগেই রপ্ত ছিল। মাইনের ভেতরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক। এর ওপর ফুটবল পাম্প করে যে- এ রকম একটা জিনিস থাকে। এখানে একটা ডেটোনেটর। তারপর একটা স্ট্রাইকার। স্ট্রাইকারটা ভেতরে ডেটোনেটরকে আঘাত করলেই বিস্ফোরিত হয়। পানিতে এটা কী করে সম্ভব? স্ট্রাইকারের ওপরে পরিমাণমতো কেমিকেল সল্ট ছিল। এটা পানিতে আস্তে গলতে থাকে। অনেকটা মোম গলার মতো। ওপরে একটা রাউন্ড ক্যাপ লাগানো। কমান্ডোদের জন্য নির্দেশ হচ্ছে- মাইন লাগিয়ে ক্যাপটা খুলে এনে আমাকে দেবে। যাতে বুঝতে পারি যে- মাইন ঠিকমতো লাগানো হয়েছে।
তো কেমিকেল সল্টটা গলে গিয়ে একটা স্প্রিং গিয়ে ডেটোনেটরকে আঘাত করে। তখন মাইন বিস্ফোরিত হয়। মোমের মতো কেমিকেলটা গলতে ৪০-৪৫ মিনিট লাগে। এরপর মাইন বিস্ফোরিত হয়। এই সিস্টেমটা এজন্য যে- কমান্ডোরা মাইন ফিট করে যাতে নির্ধারিত সময়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে পারে। যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে- নিজেদের হতাহতের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। শত্রুকে ধ্বংস করতে হবে এবং নিজেকেও বাঁচাতে হবে- এটাই কৌশল। এ জন্যই এই কেমিকেল। তো দাউদকান্দির ব্যাপারটা ছির সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অন্যান্য নৌ-কমান্ডোরা ছিলেন সরাসরি নৌবাহিনীর লোক। তাঁরা পাকিস্তান নৌজাহাজ ফ্রান্স থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। আমি একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম- বেসামরিক নৌ-কমান্ডো। আমাদের বলা হয়েছিল অপারেশনে নামতে। মাইন ফিট করে স্রোতের অনুকূলে ভাটির দিকে গিয়ে আশ্রয় নিতে। দাউদকান্দিতে এসে আমাকে স্পট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্রোতের অনুকূলে দক্ষিণ দিকে তো দাউদকান্দি ফেরিঘাট। সেখানে পাকবাহিনী থাকতে পারে। তারপর এত রাতে একই বয়সের আট যুবক সুইমিং কসটিউম পরে হেঁটে যাব। সুইমিং কস্টিউম পরা কমান্ডোকে উলঙ্গের মতোই দেখায়। আমাদের উলঙ্গ দেখে স্থানীয় লোকজন বুঝে বা না বুঝে হইচই করতে পারে। তাতে তো আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি।
এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিই- স্রোতের উল্টো দিক- অর্থাৎ চরের দিকেই আমরা আশ্রয়ে যাব। এটাকে সামরিক ভাষায় রেসকিউ পয়েন্ট বলে। আমরা সে রাতে মাইন ফিট করে উল্টো সাঁতার কেটে রেসকিউ পয়েন্টে যাই। তার ছয়-সাত মিনিটের পর নয়টি মাইন একেক করে বিস্ফোরিত হতে থাকে। পুরো দাউদকান্দি কেঁপে ওঠে। লোক জেগে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। পাকিস্তান বাহিনী তখন সমানে মেশিন দিয়ে গুলি করতে থাকে।
বাশার খান : গুলি কি আপনাদের দিকে এসেছিল?
শাহজাহান সিদ্দিকী : না। এটা একটা মজার বিষয়। তারা মনে করেছে- কেউ পশ্চিম বা দক্ষিণ দিক থেকে এসে আক্রমণ করেছে। উত্তর দিকে তো নদী আর চর- কেউ নেই। তারা এদিকে গুলি করেনি। ওই দিকে ওরা সমানে গুলি ছুড়ছে। মর্টারের গোলা মারছে। নদীর পানি ছেঁড়াবেড়া কলে ফেলতেছে। আমাদের চোখে তৃপ্তি আর আনন্দের হাসি। যুদ্ধে জয়ের আনন্দে বলতে থাকি, ‘মার শালারা মার। আমরা পার হয়ে গেছি। ধরতে পারবি না।’ মাঝিরা নৌকা বাইছিল। আমরা আটজন নৌকার তক্তা তুলে দিয়ে বৈঠা বাইতে থাকি। খুব দ্রুতই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যেতে থাকি। দ্রুতই আর দুই কিলোমিটার দূরে চলে গেলাম। আমরা যেহেতু যোদ্ধা- তাই জানি কতটুকু দূরে গেলে সম্পূর্ণ নিরাপদ হওয়া যায়। তো আমরা সে জায়গায় গিয়ে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই। তখন কি যে শান্তি-আনন্দ লাগছিল- বোঝাতে পারব না। পাকি বাহিনী বুঝতেই পারল না- কোন দিকে দিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করা হয়েছে। এরপর দেখতে পেলাম যে, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে আর্মির জিপ, লরি হেড লাইট জ্বালিয়ে দাউদকান্দি ঘাটের দিকে আসছে। তাদের ধারণা হয়েছে- মুক্তিরা ফেরিঘাট আক্রমণ করেছে। সমানে সৈন্য যাচ্ছে। এরা মনে করেছে ঘাটে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর এদিকে আমরা যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে এসেছি। তাদের তৎপরতা দেখে হাসছিলাম আমরা। অনেকটা ফিল্মের মতো। ওরা যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। আর আমরা সে যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে এসেছি। কোনো রকম ওয়ারলেস সংযোগ ছাড়া এত বড় অপারেশন সাকসেস করেছিলাম।
বাশার খান : এই অপারেশনের কারণেই আপনি বীরবিক্রম উপাধি পান? নাকি অন্য অন্য অপারেশনও বিবেচনায় ছিল?
শাহজাহান সিদ্দিকী : দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশনে সফলতার জন্যই আমাকে বীরবিক্রম উপাধি দেয় সরকার। আমার সঙ্গে থাকা ডেপুটি কমান্ডার মতিউরকে দেওয়া হয় বীরপ্রতীক খেতাব। উনি দাউদকান্দির লোক।
বাশার খান : মতিউর রহমান সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আপনার?
শাহজাহান সিদ্দিকী : মতিকে অনেক খুঁজেছি। উনি রংপুরে বিয়ে করেছিলেন। সেখানেই মারা গেছেন।
বাশার খান : বর্তমান তিতাসের বন্দরামপুর গ্রামের যে বাড়িতে ছিলেন, সেখানকার কারো সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি?
শাহজাহান সিদ্দিকী : আমরা বন্দরামপুরে পীর আল্লামা শাহ কামালের বাড়িতে ছিলাম। উনি আমাদের খুব সহযোগিতা করেছেন। পীরসাহেব আমাকে পুত (ছেলে) বলতেন। ওনার পরিবারকে আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে অন্দরমহলে আমাদের আশ্রয় দেন। ওনার সঙ্গে লিংকটা তৈরি করে ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার (যিনি ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। ৭৫-এর ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে নির্মমভাবে নিহত হন)।
বাশার খান : আক্রমণ পরিচালনা শেষে কোথায় গেলেন?
শাহজাহান সিদ্দিকী : পীরসাহেবের বাড়িতে গেলাম। পীর শাহ কামালের কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। সাধারণত পীরসাহেবরা মুক্তিযুদ্ধে নিরপেক্ষ বা মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু এই পীর ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। হুজুরের বাড়ির অন্দরমহলে পাট বিছিয়ে বিছানা পেতে আমরা থাকতাম। ভেতরে লোকজন যেতে পারত না। পীরের অন্দরমহল বলে কথা। উনি আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। ভেতর থেকে কেউই বের হতো না। একমাত্র আমি বেরুতাম। ভেতরে নয়জন ছিলাম। একজন ছিল পাবনার। সে পাবনার ভাষায় কথা বলত। এ জন্য তাকে অপারেশনে নেয়নি। আমরা সবাই ছিলাম কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার। সবাই বন্দরামপুরের স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে পারতাম। পাবনার মুক্তিযোদ্ধা তা পারত না। তাকে কথা বলতে দিলে লোকজন বুঝে ফেলবে- আমরা এখানকার লোক না। বা পীরের মুরিদ না। তাই তাকে বাদ দেই। এটা ছিল স্থানীয়দের চোখ ফাঁকি দেওয়ার কৌশল। পীরসাহেব বড় নল দিয়ে তামাক খেতেন। আমি প্রায়ই নলে তামাকের টিকা ধরিয়ে দিতাম। আমার মুখে দাড়ি ছিল। মাথায় টুপি লাগালাম। হুজুর ওড়নাও একটা নিলাম। ওখানে বিভিন্ন ধরনের লোক আসত। রাজাকারও আসত, জামায়াতের লোকও আসত। তো আমি পাকা মুরিদ সেজে গেলাম। একেবারে মাদ্রাসাছাত্র। সবাইকে সালাম দিতাম। অন্য মুরিদরাও আমাকে সালাম দিত। হুজুর সবাইকে বলতেন, ‘এই এইডা আমার পুত।’ এ জন্য কেউ সন্দেহ করেনি। হুজুরের পুত বলে। শুধু হুজুর জানতেন যে আমরা মুক্তিযোদ্ধা। হুজুর আমাদেরকে খুব সতর্কতা ও যত্নসহকারেই রেখেছিলেন।
বাশার খান : অপারেশনটি সফল করার ব্যাপারে দাউদকান্দির স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে কি কোনো সহযোগিতা পেয়েছিলেন?
শাহজাহান সিদ্দিকী : এটা অত্যন্ত গোপন অপারেশন ছিল। সহযোগিতা যা পেয়েছি পীর শাহ কামালের কাছ থেকেই। প্রথম দিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম ঝড়-বৃষ্টির কারণে। হুজুরকে বললাম, হুজুর আমাদের একটা ছৈ-ওয়ালা নৌকা আর আরেকটা কোষা নাও দেবেন। উনি দুটোরই ব্যবস্থা করলেন। যদিও ১৬ আগস্ট আকাশ ভালো ছিল। অপারেশন শেষ করে যখন এলাম, ঘাটে নৌকা ভেড়ানোর সময় দেখি- হুজুর সেখানে খুব পেরেশান হয়ে পায়চারি করছেন। তিনি আমাকে দেখেই ‘পুত তুই আইছত’ বলেই বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ‘পুত তুই যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার পরই বিকট আওয়াজে ভূমিকম্পের মতো একটা কিছু হলো। আমি তো টেনশনে পড়ে গেলাম। তোদের কিছু হলো কি না। তোরাও বাইর হইলি- এরপর এমন বিকট আওয়াজটা হলো। সবাই ঘুম থেকে জাইগা গেছে। আমি তোদের চিন্তায় ঘাটে আইয়া রইছি।’ উনি কাঁপতে কাঁপতে বলছিলেন।
আমি তখন কানের কাছে গিয়ে বললাম, ‘হুজুর আপনার পুতেই এই আওয়াজ করে আসছে।’ উনি বললেন, ‘কি করছস পুত?’ আমি আস্তে আস্তে বললাম, ‘দাউদকান্দি ফেরিঘাটের ফেরি, জাহাজ ও পন্টুন মাইন দিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে আসছি।’ উনি তখন আমাকে আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরেন। বললেন, ‘পুত কয়েকদিন আগে আমার এক মুরিদ পাট ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জে পাট বিক্রি করে আসছিল। দাউদকান্দি আসার পর সেখানকার রাজাকার ও পাকবাহিনী তাকে ইশারা করে থামায়। টাকা-পয়সা সব রেখে দেয়। ব্যবসার সব টাকা নিয়ে নেয়। আমার মুরিদ খালি হাতে ফিরে আসে। মুরিদ কাঁদতে কাঁদতে এই ঘটনা আমারে জানায়। তখন আল্লাহর কাছে আমি দোয়া করি, হে আল্লাহ, তুমি এই জালিমদের ওপর গজব নাজিল করো। আজ রাতে তোদের মাধ্যমে আল্লাহ সেই গজব নাজিল করছে রে পুত।’
এরপর উনি আমাদের নাশতার ব্যবস্থা করলেন। সকাল হলেই দেখি, এক লোক চিঁড়া ও দুধ-কাঁঠাল নিয়ে এসেছে। পীরসাহেব বললেন, ‘এই সে আমার পাট ব্যবসায়ী মুরিদ। মুক্তিরা দাউদকান্দি ফেরিঘাট উড়াই দিছে- এই বলে তাকে খবর দিছিলাম। তবে তগো কথা কই নাই। সে খুশি হয়ে এই খাবার নিয়ে আসছে।’ উনি আমাদের কথা বলেননি। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেছেন। পীরসাহেবের সহযোগিতা ছিল বড় ব্যাপার। পরে শুনেছি- ওনার ছেলেও মুক্তিযোদ্ধা ছিল। পীর শাহ কামালের স্মৃতি আজও চোখে ভাসছে। হুজুরে বিচক্ষণতা ও সতর্কতার কারণে কেউ টের পাইনি যে আমরা মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো। স্থানীয় রাজাকার, মুসলিম লীগ বা পাকবাহিনীর কেউ টের পেলে তো আমাদের মারত, হুজুরকেও মারত।