আন্তর্জাতিক
কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কী?
কাশ্মীরে অশান্তি চলছেই। ৭২ দিন ধরে হরতাল পালন করছে জনগণ। চলছে কারফিউ। প্রাণ গেছে অন্তত ৮৬ জনের। অন্যদিকে, সশস্ত্র প্রতিরোধকারীরা রোববার বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে সেনাঘাঁটিতে। সেখানে প্রাণ গেছে ১৭ জন ভারতীয় সেনার। অর্থাৎ ভারতীয় বাহিনীকে এখন দুই দিকে লড়তে হচ্ছে। একদিকে অসন্তুষ্ট জনগণের সঙ্গে রাজপথে, অন্যদিকে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে। অনুমান করা হয়, এই অস্থিরতায় পাকিস্তানের ডিপ স্টেট সহায়তা করে থাকতে পারে।
অস্বীকার করা যাবে না যে ফ্রান্স, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে আতঙ্ক আর উদ্বেগপূর্ণ এলাকা। একুশ শতকের বিশ্বশান্তির জন্য নতুন মাত্রার সমস্যা এগুলো। কিন্তু ফিলিস্তিন, কাশ্মীর বা উত্তর-আয়ারল্যান্ডের মতো জায়গাগুলোর সমস্যা ভিন্ন রকম। এগুলোকে বলা হয় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত (Protracted Conflict)। এসব সমস্যা গত শতকের বিশ্বব্যবস্থার গ্লানিকর কিছু রাজনৈতিক ঘটনার ফসল। এসব জায়গায় সংঘাত কিংবা প্রাণহানি রীতিমতো গা-সওয়া হয়ে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে কাশ্মীরে চলছে নিরবচ্ছিন্ন অচলাবস্থা।
সংঘর্ষ বা কনফ্লিক্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীতে সংঘাত একটি নিরন্তর বাস্তবতা। সৃষ্টির শুরু থেকেই নানা ধরনের সংঘাতের মধ্য দিয়েই বিশ্বব্যবস্থা এগিয়ে চলেছে। আবার সংঘাত নিরসন করে শন্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও এসেছে একের পর এক। ইয়োহান গালটুং, উইলিয়াম উরিসহ বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের পুরোধাব্যক্তিরা তাই এখন বলছেন, সংঘাত যেমন সর্বকালীন, শান্তিরক্ষার প্রচেষ্টাও তেমন সর্বকালীন। তাঁরা বলছেন, পৃথিবী যতদিন আছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় ভূমিকা ততদিন চালিয়ে যেতে হবে। যে কোনো সময় একটি সংঘাতের সমাধান হওয়ার পর সামান্য কারণে আবার সেখানে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এ জন্য পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের জনক ইয়োহান গালটুং তার ‘সক্রিয় শান্তি’ (Active Peace) তত্ত্বে সংঘাত নিরসনের তিনটি পর্যায় ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রথমত, সংঘাত ব্যবস্থাপনা (Conflict Management) : অর্থাৎ, যে কোনো উপায়ে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা। এই পর্বে অন্তত সহিংসতা ও প্রাণহানির অবসান ঘটানোর চেষ্টা হয়। এ অবস্থাকে অনেকে আর্মড পিস হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এই অবস্থায়ও বিরোধপূর্ণ পক্ষগুলো একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। চরম যুদ্ধাবস্থা থেকে এই প্রথম পর্যায়ে উন্নীত করার প্রচেষ্টাকে শান্তি রক্ষা (Peace Keeping) বলা হয়। শান্তি রক্ষার এই পর্যায় থেকেও সামান্য কারণে আবার যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। যেমনটা হয় কাশ্মীরে।
এই দেখা যায় সবকিছু স্বাভাবিক, কোনো প্রাণহাণি নেই। প্রতিবাদ নেই। পর্যটকরা যাচ্ছে। নির্বাচন হচ্ছে। ভারত সরকার বলছে সবকিছু ঠিকঠাক। স্বাভাবিক। কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে ভালোভাবেই আছে। ভূ-স্বর্গে স্বর্গীয় শান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু হঠাৎ করেই কোনো এক জঙ্গলে বুরহানের মৃত্যু হলো। আর শান্তির পায়রা উড়ে গেল। এই সশস্ত্র শান্তি (Armed Peace) আসলে প্রকৃত শান্তি নয়। পৃথিবীর সব সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা শান্তি বলতে এই পর্যন্তই বোঝে। তাদের বয়ানে শান্তি মানেই হলো যেখানে যুদ্ধ নেই। মিলিটারিজম বিশ্বাস করে যে, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হয়’। এ জন্য, পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯ শতককে বলা হয় শান্তির শতক। কারণ, ওই শতকে কোথাও বড় কোনো যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ওই শান্তি পরের শতকে এসে অশান্তি হয়ে গেল। বিশ্বযুদ্ধে জ্বলে উঠল দুনিয়া। এরপর বাকি সময় ধরে চলল, শীতল যুদ্ধ আর অসংখ্য স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রমাণ হয়ে গেল, সশস্ত্র শান্তি আসলে শান্তি নয়।
সংঘাত সমাধানের দ্বিতীয় পর্যায়কে গালটুং বলছেন সংঘাত নিরসন (Conflict Resolution)। এই পর্বে বিবদমান সবগুলো পক্ষ একে অপরের কথা শুনতে আগ্রহী হবে। তারা প্রত্যেকেই অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। সবাই মিলে একটা সমঝোতায় আসে বা আসতে চায়। এই কার্যটি বিবদমান পক্ষগুলো নিজেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে করতে পারে। আবার সেখানে তৃতীয় কোনো পক্ষ মধ্যস্থতা করতে পারে। তৃতীয় পক্ষ তাদের সমঝোতায় আসতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধ্যও করতে পারে, সালিস ব্যবস্থার মতো। সক্রিয়তার এই দ্বিতীয় পর্বকে গালটুং বলেছেন শান্তি তৈরি (Peace Making)। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি মূলত এই পর্যায়েরই শুরু। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পৌনে এক শতাব্দীব্যাপী চলমান বিরোধের সমাধান কাজ এই পর্ব পর্যন্ত আসতেই পারেনি। বারবার এই কাজটি বাধা পেয়েছে। কখনো ভারতের কারণে, কখনো পাকিস্তানের কারণে, কখনো বা উভয় দেশের অনাগ্রহে। আবার কখনো অন্য কোনো কারণে।
মনে রাখতে হবে, বিরোধ নিরসন করতে হলে সবার আগে চিহ্নিত করতে হয় বিবাদমান বিষয়ের স্টেকহোল্ডার বা পার্টি কে কে? মজার ব্যাপার হলো, কাশ্মীর সমস্যায় এই পার্টি বা স্টেকহোল্ডারই ঠিক করা হয়নি আজও। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীর সমস্যাকে ভারত জাতিসংঘে উত্থাপন করার পর জাতিসংঘ অন্তত ২৭টি রেজুলেশন আনে। তাতে কাশ্মীরি জনগণকে এই বিরোধের আলাদা স্টেকহোল্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে জনগণকেই তাদের রাজনৈতিক গন্তব্য নির্ধারণের সুযোগ রাখা হয় সেখানে। কিন্তু শিমলা চুক্তি-১৯৭২ অনুসারে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ও ভারত একে অপরকে স্টেকহোল্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও জনগণকে এড়িয়ে যায়। তাতে বলা হয়েছে কাশ্মীরসহ দুই দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিষয়াবলি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে। এই চুক্তির মাধ্যমে মূলত জনগণ হিসাবের বাইরে চলে যায়। ওই চুক্তির পর থেকে ভারত সালিসদার হিসেবে কাউকেই স্বীকার করেনি। মূলত, ১৯৭১-এ পরাজয়ের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো নিরুপায় হয়েই ওই চুক্তি সই করেছিলেন। অন্যদিকে, সম্ভবত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় স্বার্থ হাসিল হবে না বুঝেই পাকিস্তান জাতিসংঘে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আলোচনায় সব সময় সক্রিয় হয়েছে। পাকিস্তান তখন থেকেই জাতিসংঘের ভূমিকা চেয়েছে। ভারত দাবি করেছে, কাশ্মীরের উভয় পাশ থেকে জাতিসংঘের মিলিটারি পর্যবেক্ষণ অফিস সরিয়ে নিতে। যদিও জাতিসংঘ তা করেনি। এখনো জাতিসংঘ তার প্রতিটি বিবৃতিতে কাশ্মীরকে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিরোধ হিসেবে তুলে ধরে। গত সপ্তাহেও জাতিসংঘে অভিযোগ উঠিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান এখন বলছে জনগণই এখানে প্রথম পার্টি। তাদের মতামতই মূল।
আরেকটি নিষ্ঠুর সত্য কথা হলো, ৯/১১-এর পর থেকে আন্তর্জাতিক মহল ধীরে ধীরে কাশ্মীরের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। পাকিস্তানের বন্ধু দেশগুলো এখন শত্রুতে পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতকেই প্রয়োজনীয় মনে করছেন বিশ্বমোড়লরা। পৃথিবীতে নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে কাশ্মীর সমস্যাকে সমস্যা হিসেবেই অস্বীকার করতে শুরু করেছে ভারত। ভারতের প্রতিনিধিদের এখনকার বক্তব্যগুলো হলো, কাশ্মীর একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার যেখানে পাকিস্তান অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করছে। মোদ্দা কথা, যদি কাশ্মীরকে সমস্যা হিসেবেই অস্বীকার করা হয়, তাহলে সমাধান বা বিরোধ নিরসন অসম্ভব। আর এভাবেই, দীর্ঘায়িত কাশ্মীর সমস্যাকে আরো দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, বিবদমান সব পক্ষকে আস্থায় না এনে বিরোধের সীমাংসা সম্ভব নয়। কাশ্মীরের বিরোধ নিরসনের এই পর্যায়কে সফল করার ক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, কাশ্মীর বলতে মূলত ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ হিসেবে পরিচিত ১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটিকে বোঝায়। আর ওই রাজ্যের জনগণকে একটি স্টেকহোল্ডার বা পার্টি হিসেবে স্বীকৃতির কথা আলোচনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ওখানকার জনগণ কি আসলে একটি পার্টি? কিছুতেই না। তাদের মধ্যে অন্তত তিন ধরনের মতামত আছে।
যাই হোক, শেষ কথা হলো, কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে আগে মানতে হবে যে কাশ্মীর একটা বিরোধ। তারপর, স্বীকার করতে হবে, প্রত্যেকটি পক্ষ বা স্টেকহোল্ডারকে। তারপর প্রত্যেক স্টেকহোল্ডারের একে অপরের কথা শুনতে হবে। শান্তি হতে হবে প্রত্যেক পক্ষের মূল স্বার্থ। কিন্তু তা হচ্ছে কি? দুটি রাষ্ট্রের কাছে সেটাই প্রশ্ন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা এবং কালোরা শান্তির স্বার্থে এক হয়েছিল। কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান এবং কাশ্মীরিরা তা পারবে কি? কাশ্মীর বিরোধের কোনো স্টেকহোল্ডার আমরা নই। শান্তির আশা করা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে আমাদের!
গালটুংয়ের শান্তি প্রচেষ্টার তৃতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা কাশ্মীর ইস্যুতে অপ্রয়োজনীয়। তবু বলে রাখা দরকার। তা হলো পৃথিবীর যেসব সংঘাত নিরসন হয়েছে সেটাও পূর্ণ শান্তির নিশ্চয়তা নয়। শান্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা হবে তখনই, যখন সংঘাত পরিবর্তিত হবে সম্প্রীতিতে। একে গালটুং বলেছেন Conflict Transformation। এই পর্বে উন্নীত হলে বিবদমান পক্ষগুলো একে অপরকে আর শত্রু ভাববে না, ঘৃণা করবে না। কাশ্মীরে সেই পর্যায়ের শান্তির আশা করা গেলেও বাস্তবতা সুদূর পরাহত মনে হয়। এখন অবিলম্বে সব পক্ষের কাছে অন্তত প্রাণহানি বন্ধ করার মিনতি রইল।
লেখক : ‘কাশ্মীর ও দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর (২০১৪-১৬) ডিগ্রি নিয়েছেন কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।