স্বাধীন ভাবনা
‘বাংলাদেশের অর্জন অনেক’
বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের ৪৫ বছর পূর্ণ হলো। বাঙালি জাতি ও জনগণের সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা । রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত হয় এই বিজয়। বিজয়ের ৪৫ বছর পর দেশ নিয়ে কী ভাবছে এ দেশের তরুণ সমাজ? সেটা জানতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে এনটিভি অনলাইনের এই বিশেষ আয়োজন ‘স্বাধীন ভাবনা’। আজ থাকছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাবনা।
অমর্ত্য গালিব চৌধুরী
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পত্র-পত্রিকায় যখন দেখি, দেশ মানব উন্নয়নসহ নানা সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, তখন অস্বীকার করব না, ভালোই লাগে। কিন্তু কিছু প্রশ্নও মাথায় উঁকি দেয়। কতটা উন্নয়ন সাধারণ মানুষের হয়েছে? শহরগুলোতে বস্তি গজিয়ে ওঠার তো কোনো বিরাম নেই, তাহলে এই সম্পদ বৃদ্ধির সুফলগুলো কোথায় যাচ্ছে? দুর্নীতি বা অন্যান্য মারাত্মক অপরাধের কতটা সমাধান হচ্ছে?
আমি এমন একটি দেশ চাই না, যেখানকার নাগরিকরা আর্থিক উন্নতির নেশায় পরিবেশ, মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিক। আমাদের বনগুলো ধ্বংসের পথে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ক্রমেই কমছে, সাম্প্রদায়িকতা বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, কমছে না নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা, আমাদের শহরগুলো ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে; এইগুলোর সমাধানের লক্ষ্যে পরিকল্পিত কাজ হওয়া দরকার। এসব সমস্যার রাতারাতি সমাধান হবে না জানি, কিন্তু রাতারাতি উন্নত দেশ হয়ে যাওয়ার দিবাস্বপ্ন না দেখে বরং এই সকল লক্ষ্যে দেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে, এটা দেখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করব।
কাজেই কেমন দেশ চাই? এ প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা, আবার কঠিনও। অবশ্যই গত ৪৫ বছরে আমাদের অনেক অর্জন আছে; নারীশিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, আয় বৃদ্ধি, তালিকাটা নেহাত ছোট নয়। সেগুলোর জন্য আমি গর্ববোধও করি, কিন্তু সেই উন্নতির ধারাটা আরো বেগবান হচ্ছে, এটা দেখতে চাওয়াই স্বাভাবিক। আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বরং সবাই সেই উদ্দেশ্য সাধনে মত্ত হোক, এটাই আমার চাওয়া। তরুণ সমাজ রাজনীতিবিমুখ না হয়ে বরং সুস্থ রাজনীতির চর্চা করবে, দেশের মানুষ পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে সচেতন হবে (এমন ঘনবসতি পূর্ণ দেশে টিকে থাকার এটাই একমাত্র সমাধান), দেশের নাগরিকরা পরিচিত হবেন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং এক ও অভিন্ন বাংলাদেশি জাতি হিসেবে, এই হলো আমার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন। আমাদের দেশে প্রতিভার বা সম্ভাবনার কোনো অভাব নেই, অভাব হলো পরিচর্যার, সঠিক পরিকল্পনার। ওই অভাবটুকু পুষিয়ে দিতে পারলে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না।
সাফি উল্লাহ্
শিক্ষার্থী, এমএ (সাহিত্য), ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে, মানুষের জীবনকে, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের আগের সাহিত্য উপাদানের সঙ্গে পরের সাহিত্য উপাদানের বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চরিত্র, ঘটনা, এমনকি অনুষঙ্গ বারবার বাংলাদেশি সাহিত্যে এসেছে। আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুর রাহমান, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামসহ অনেকেই সেগুলো ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের আবেগ ও অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, জিনাত আরা রফিক, আলতাফ হোসেন, আসাদ চৌধুরীর লেখনীতে।
আবার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের উপনিবেশিকতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব জাতিসত্তা এবং পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশি লেখকরা সাহিত্য রচনায় মন দিয়েছেন। সাব-অলটার্নদের জোরালো কণ্ঠস্বর উপস্থাপন, প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, প্রান্ত ও কেন্দ্রের মাঝের দূরত্ব মুছে ফেলা, গণতন্ত্রায়নসহ উত্তরাধুনিকতার নানা অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের সাহিত্যের আরেকটি অন্যতম অর্জন হলো কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের বাইরে এসে নতুন মডেল সৃষ্টি করতে পারা।
সাহিত্য-সমালোচনা জগতেও প্রভাব পড়েছে। postcolonial studies of literature, অর্থাৎ সাহিত্যের উত্তর-উপনিবেশিক অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা বিশ্বসাহিত্য, বিশেষভাবে ইংরেজি সাহিত্য পড়ি। যেমন, রবিনসন ক্রুশোকে ঔপনিবেশিক এজেন্ডা হিসেবে দেখতে সাহস পাই। এমনকি উইলিয়াম শেকসপিয়রের মতো বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকারের নাটক পড়ি উত্তর-ঔপনিবেশিকতার অবস্থান থেকে। জোনাথান সুইফটের গালিভার্স ট্রাভেলস ব্যাখ্যা করি আমাদের মতো করে। এমনকি আমরা উত্তর-উপনিবেশ ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা এবং অধিকার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসেবে পেয়েছি।
পরিশেষে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সাহিত্যে যে নতুন মাত্রা দান করেছে, তা আমাদের ‘আমরা’ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং জগৎ দান করেছে।
জেবুন নেসা আলী ঊর্মি
শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সহজ ও সরল কিছু সুন্দর মনের মানুষের দেশ। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশ। বাংলাদেশ কোটি মানুষের স্বপ্নের দেশ, সোনালি আঁশের দেশ, লাল-সবুজের দেশ, হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর সোনার দেশ, সুন্দরবনের ছায়ায় ঘেরা এক মায়াবী দেশ, সমুদ্রের ঢেউয়ে গর্জে ওঠা এক শক্তিশালী দেশ। কে বলে বাংলাদেশ দরিদ্রতম দেশ? বাংলাদেশ যে কোটি কৃষকের হাতে গড়া এক উচ্ছল দেশ। আমরা পোশাকশিল্পে সেরা। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি উন্নয়নের দিকে প্রতিদিনই একটু একটু করে। চাকরি, সেবা ও র্যাংকিং খাতে আমাদের অর্জন ব্যাপক। আমরাই পারি বিশ্বকে জানিয়ে দিতে জাতি হিসেবে আমরা কোনো অংশে কম নই।
ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস
শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লাখো বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা সাত কোটি বাঙালিকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে মুক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। আমরা এমন একটা দেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যেখানে থাকবে না কোন শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ষণ-নির্যাতন ও থাকবে না কোনো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সুপ্ত প্রতিভা ও সৃজনশীলতার বিকাশের মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হবে নতুন নতুন দ্বার, কমতে থাকবে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, এমনটা ঘটেনি। এখন যেদিকে নজর যায়, সেদিকেই দেখি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, লুটপাট, শিক্ষা বাণিজ্য, ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা। এমনকি স্বপ্ন দেখার সাহসও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আজ ৪৫তম বিজয় দিবসে আমাদের একটাই চাওয়া, সে সাহস ও উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনতে হবে আর ধারণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
শাদমান জাহিন
শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ, তোমার স্বাধীনতার ৪৫ বছরে পদার্পণটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমগ্র বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। পোশাক ও চামড়া উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানি শিল্পে বাংলাদেশ পেয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অর্জন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তবে সুস্থধারা রাজনীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, লিঙ্গ ও শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। আমি আশা করি, আসন্ন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ সব অপূর্ণতা ও বিফলতা দূর করে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
মো. আবুবকর সিদ্দিক
লেখক, তৃতীয় বর্ষ, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই সোনার বাংলা। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তিতেও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে একটু দেরিতে হলেও এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে। বাংলাদেশের সর্বত্র তথা-ব্যবসায়, শিক্ষা, কৃষি, উন্নয়নমূলক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সব কর্মক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধশালী ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চায় এ দেশের সরকার ও জনগণ। এ লক্ষ্যে প্রযুক্তির উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরগুলো। পাশাপাশি এ দেশের জনগোষ্ঠীকে তথ্য ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি’ নামের একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে পারে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারিভাবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনে ও পরিচালনায় গড়ে উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়া অনলাইনে এসব শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তো রয়েছেই। ফলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে একদিন প্রযুক্তিবিদের ছড়াছড়ি হবে।