স্বাধীন ভাবনা
কী নিয়ে প্রত্যাশা পূরণ করব?
আমরা তো অনেক প্রত্যাশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি জানি, সেসব মুক্তিযোদ্ধা এবং সারা দেশের মানুষের যে স্বপ্ন ছিল এবং সেই স্বপ্নের প্রতিফলন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ থাকতে থাকতেই রচিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান। যেখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—এগুলো স্থান পেয়েছিল।
এখন সমাজতন্ত্র তো অনেক দূরে। আমি শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনীতি মিলিয়ে আত্মসামাজিক অবস্থাটা বলতে চাই। আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নের কিছুই পূরণ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা যে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, এটার জন্য এত মানুষ প্রাণ দিল। আমরাও লড়াই করেছি। এই পাওয়াটাকে আমি কম বলছি না। এটা অনেক বড় পাওয়া, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানিদের সেই দাসত্ব থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। পাকিস্তানিদের আদর্শকে আমরা অনেকখানি পরাজিত করতে পেরেছি। এটা খুব বড় ব্যাপার। মানুষের মনে ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা; কিন্তু মানুষের যতখানি স্বপ্ন ছিল, সেটাই পূরণ হয়নি। মুক্তি তো দূরের কথা।
সমাজতন্ত্র বদলে এখন নিকৃষ্ট ধরনের পুঁজিবাদ চেপে বসেছে। কিছু অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বলা হয়। এখন পার ক্যাপিটাল ইনকাম বেড়েছে। তার মানে হচ্ছে, কিছু লোকের প্রচুর টাকা হয়েছে। হাজার কোটি টাকার মানুষ আছে এই দেশে এবং প্রতিবছর দেখা যাচ্ছে, সুইস ব্যাংককে বাংলাদেশিদের জমানো টাকার সংখ্যা বাড়ছে। কিছু কিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ থেকে বটগাছ হয়েছে। কিন্তু গরিব মানুষের সঙ্গে বৈষম্য বাড়ছে। উন্নতি হয়েছে, ৪৫/৪৬ বছরে উন্নতি তো হবেই। রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট, বাড়িঘর। কিন্তু সমাজতন্ত্র অনেক দূরে ফেলে এসেছি।
ধর্মনিরপেক্ষতা আমরা যেভাবে আশা করেছিলাম, সেই জায়গাটা কিন্তু থাকেনি। এর মধ্যে রাষ্ট্রধর্ম ঢুকে গেছে। সেটা বর্তমান সরকার যারা স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে দাবি করে, নেতৃত্ব দিয়েছিল এটা সত্য কথা, সেই দলও আজ মূল বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে পারছে না। এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিটাকে আঘাত করে, যেটা এরশাদ করে গেছেন। বর্তমান সরকার অনেক কিছু পরিবর্তন করল। কিন্তু এটাকে পরিবর্তন করতে পারছে না।
তারপর এই কদিন আগে নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলা হলো, ২০১২ সালে হামলা হলো রামুতে, এ রকম বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলছে। এটা খুব খারাপ।
আর গণতন্ত্র! নির্বাচনও নেই, গণতন্ত্রও নেই। নির্বাচনের আগের রাতে সিল মারা হয়। ২০১৪ সালের পর গণতন্ত্র বলে আর কিছু আছে কি? সংসদীয় গণতন্ত্র হোক আর যে গণতন্ত্রই, কোনো ধরনের গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের একটা ব্যাপার হলো নির্বাচন। সেটা সংসদীয় হোক, প্রেসিডেনশিয়াল হোক। এখন তো নির্বাচনই নেই। আমরা সর্বশেষ ইউপি নির্বাচন দেখলাম, পৌরসভা নির্বাচন দেখলাম, তার আগে উপজেলা নির্বাচন দেখলাম। এসব কী দেখছি? এটাকে কি নির্বাচন বলে?
তারপর ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অন্যায়, অত্যাচার, লুণ্ঠন চলছে। ফলে গণতন্ত্র নেই, সমাজতন্ত্র নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, জাতীয়তাবাদও নেই।
কী নিয়ে প্রত্যাশা পূরণ করব বলুন?
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, সিপিবি।