স্বাধীন ভাবনা
গ্রামের সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে সক্রিয় কি?
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি কতটুকু এগিয়েছে, এটার তো কোনো হিসাব করা নেই। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি কোনটা থেকে এগিয়েছে, সেটাও সুনিশ্চিত নয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধটা কিন্তু আমাদের লড়তে হয়েছে, এর পর স্বাধীনতা পেয়েছি। কাজেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি কতটুকু এগোল, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
একাত্তরের আগে আমাদের দেশে যে সরকার ছিল, সে সরকারের অনেক সীমিত ক্ষমতা ছিল। মানুষের ওপর অনেক বেশি নির্যাতন হয়েছে। সাধারণ মানুষ দেশের ভেতরে ছিল আর সরকার ছিল দেশের বাইরে। সেনাবাহিনী ছিল দেশের বাইরে। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতার বলয়ও একটা বিষয় ছিল, সমস্যা ছিল। যারা ক্ষমতায় আসছিল, তারা মোটমুটি ওপরতালার মানুষ। যেকোনোভাবেই হোক। সে সরকারি হোক, আমলা হোক বা সেনাবাহিনী থাকুক। আর সাধারণ মানুষ যে যুদ্ধ করেছিল বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা আবার তাদের স্ব-স্ব জায়গায় ফেরত গেছে। এটা হলো মৌলিক।
যা হোক, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় আসতেন, তাহলে কী হতো তা আমরা বলতে পারি না। হয়তো অবস্থা অন্য রকম হতো। কিন্তু যুদ্ধের পরে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরাও ওই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছেন—একদলীয় শাসন, রক্ষী বাহিনী এসবের কথা বলছি।
এর পরে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন দেখি আমি, যেটা সেনাবাহিনীর লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি যে সেনাবাহিনী নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। নভেম্বরে যে হত্যাকাণ্ড হলো, ঝামেলা হলো, গণ্ডগোল হলো, যেটাই বলি না কেন। সেটার মাধ্যমে নতুন একটা ক্ষমতাবান গোষ্ঠী রাজনীতিতে প্রবেশ করল, সেটা হচ্ছে সেনাবাহিনী। কাজেই অনেকগুলো শক্তি এসে গেল। সেনাবাহিনী এসে গেল, রাজনীতিবিদ এসে গেল, আমলা এসে গেল এদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বটা চলেছে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০ সাল থেকে দেখা গেল যে মধ্যবর্তী শ্রেণি ওপরে উঠে আসছে। এবং মধ্যবর্তী শ্রেণির চাপের কারণেই ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনটা হয়েছে। সেই গণআন্দোলন হস্তক্ষেপে ১৯৯০ সালের পর অর্থনৈতিক উন্নতিটা অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে। সেখানে কিন্তু গরিব মানুষের রাজনৈতিক ভূমিকা থাকার কথা না। গরিব মানুষ তো রাজনীতি করে না।
আমাদের দেশে কার রাজনীতি এগিয়েছে? আমার ধারণা, বড়লোকের রাজনীতি অনেক এগিয়েছে। গরিব মানুষের রাজনীতি হয়েছে কি? গরিব মানুষের রাজনীতি হয়নি। মধ্যবিত্ত মানুষের রাজনীতি হয়নি। মধ্যবিত্ত রাজনীতিতে বড়লোকদের যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তার চারপাশে ঘুরঘুর করে। মধ্যবিত্তদের এখন প্রতিষ্ঠিত একটা জায়গা, সেটা হচ্ছে গণমাধ্যমে। মধ্যবিত্ত বেছে নিয়েছে গণমাধ্যমকে।
যেহেতু সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি আমাদের দেশে নেই, আমাদের দেশের রাজনীতিগুলো শ্রেণিভিত্তিক হয়েছে। বড়লোকরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ, যে পরিমাণ অর্থবিত্ত দরকার হয়, আমাদের দেশের রাজনীতি করার জন্য তা কেবল বড়লোকদেরই হতে পারে। গ্রামেও যদি দেখা যায়, যে নতুন বড়লোক শ্রেণি তৈরি হয়েছে, সেটা বিদেশে গিয়ে হোক অথবা গ্রামের কৃষিব্যবস্থার কারণে, তারাও কিন্তু শহরে আসছে এবং শহরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। গ্রামের বড়লোক আর শহরের বড়লোকের মধ্যে আবার সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই রাজনীতি হয়। কিন্তু গরিব মানুষের রাজনীতি আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। গরিব মানুষ অনেকটা বিচ্ছিন্ন থেকে গেছে। গরিব মানুষের প্রতিষ্ঠানগুলো কী? গরিব মানুষের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। কিন্তু গরিব মানুষ রাজনীতি করে না। গরিব মানুষ রাজনীতির ক্ষমতার অংশও চাইতে আসে না। তারা ভোট দিতে যায়, কিন্তু ভোট দেওয়া আর রাজনীতি এক নয়। আমাদের দেশে রাজনীতি বলতে কিন্তু গণতন্ত্রের কথা বলি, আমরা বলি যে আমাদের ভোট।
কিন্তু আমাদের দেশের ভোট যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে আমরা কোনো দিনই ভোটের প্রতিষ্ঠানকে সবল করিনি কেন। নিজেদের স্বার্থে সবল করিনি, সে যে দলই হোক। আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক, জাতীয় পার্টি হোক, জাসদ হোক, কমিউনিস্ট পার্টি হোক—সবাই নিজেদের অবস্থানটাকে সবল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন ছিল, সেটা তারা করেনি। ১৯৭১ সালটা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব হতো না। কিন্তু ১৯৭১-এর পরে মানুষের যে বিশাল স্বপ্ন, সেটা সামাল দিতে গেলে তো আর বড়লোক যারা, ক্ষমতাবান, তাদের দিকে তাকানো যায় না। তো, আমাদের দেশে এইটাই হয়েছে। এটা ভালোও না, খারাপও না—এটাই হচ্ছে শ্রেণি রাজনীতির পরিচয়। এ রকমভাবেই শ্রেণিরা রাজনীতি করে।
আগামীতে যদি আমাদের আরো উন্নতি হয়, গরিব শ্রেণির হাতে যদি পুঁজি থাকে, গরিব শ্রেণির হাতে যদি রাজনীতি থাকে, তাহলে তখন গরিব শ্রেণি তার নিজস্ব রাজনীতি তৈরি করবে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গরিব শ্রেণি রাজনীতি করতে চায়ও না। ভোটের কাছে যেতে চায়, রাজনীতির কাছে যেতে চায় না। সেই কারণেই তার প্রতিষ্ঠান ছিল গ্রামভিত্তিক।
এখন একটা মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, সেটা হলো এবার যে গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ যে নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো দলভিত্তিক হয়েছে। তার মানে গ্রামের রাজনীতি। এইটা তো গ্রাম থেকে উঠে আসা রাজনীতি না, এটা শহর থেকে গ্রামে রাজনীতি চলে গেছে। যেটা আমাদের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যেটা ছিল গ্রামের মানুষ সক্রিয় ছিল রাজনীতি করতে, সেটা কিন্তু কেবল নেতাভিত্তিক ছিল না। এখন যেটা হবে, সেটা তো অবস্থা সম্পূর্ণ মানুষরাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করবে। একটা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করতে ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি খরচ হয়। কাজেই গরিব মানুষের রাজনীতি আর তৈরি হয়নি। গ্রামের মধ্যবিত্তের রাজনীতিও তৈরি হয়নি। দেখা যাচ্ছে, শহরের বড়লোক আর গ্রামের বড়লোক হাত মেলাচ্ছে। ঢাকা শহর তো কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশের, সেটাও বড়লোকদের হাতেই আছে। অতএব, রাজনীতিটা এগিয়েছে। রাজনীতি কার জন্য আগায়নি, সেটা আমাদের দেখতে হবে।
মধ্যবিত্ত রাজনীতি করতে চায়, আবার বেশি কষ্টও করতে চায় না, এটা মধ্যবিত্তের চরিত্র। সে গণমাধ্যমে কথা বলে, সে টক শোতে যায়, সে পত্রিকায় কলাম লিখে, কিন্তু কোনোটাই সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। মোটামুটি রাজনীতিটা যাদের হাতে আছে, তারা অত্যন্ত সবল। সেটা হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, পৃথিবীর কম ইতিহাসেই এ রকমটা হয়। সেটা হচ্ছে বড়লোক, অর্থাৎ ব্যবসায়ী শ্রেণি, রাজনৈতিক শ্রেণি এবং আমলা শ্রেণি মোটামুটি একই পরিসরে চলে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই, যেহেতু গরিব মানুষ তো আর রাজনীতি করে না। যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য যখন জবাবদিহির প্রয়োজন, তখন সে জবাবদিহি করে। জবাবদিহি কেন? একটা সমাজের প্রয়োজন হলেই জবাবদিহিটা হয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে কি জবাবদিহির প্রয়োজন আছে? ৪৫ বছর পরে রাজনীতিতে তো জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রয়োজন আছে? না। আমাদের দেশে বড়লোক হওয়ার জন্য কি নিয়ম মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করার দরকার আছে? না। আমাদের দেশে যখন আমলারা চুরি-বাটপারি করে, তখন কি তাদের শাস্তি হয়? না। তাহলে আমাদের দেশে সফল হওয়ার জন্য গণতন্ত্র অথবা জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। সে কারণেই আমাদের দেশে আজ এটা নেই।
এখন আজকের দিনে যে জিনিসটা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি গণমাধ্যমকে দিয়ে এক ধরনের বড় প্রতিবাদ করছে, খবর পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু গণমাধ্যমের মালিকানা যেহেতু বড়লোকেরই হাতে এবং সব সময় বড়লোকের হাতেই থাকবে, এই টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্রিকা সে কারণেই বড়লোক আরো সবল হচ্ছে। আমাদের দেশে যে ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয় অংশ সবল হতে পারত, সেটা হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। অনলআইনটা হচ্ছে মধ্যবিত্তের, কারণ অনলাইন করতে পয়সা লাগে না। সে কারণে সক্রিয় হতে পারত।
যারা এখন ক্ষমতায় আছে, তারা অনলাইনকে কতদূর এগোতে দেবে, সেটা হলো বিষয়। দ্বিতীয় হলো অভ্যন্তরীণ ডিসিপ্লিন আছে কি না, যারা অনলাইন করছে, যারা এই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষণ আছে কি না। অনলাইন পত্রিকা কীভাবে চালাতে হয়, সেটা তারা জানে কি না। কোনো খবর দিলে কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাও তারা জানে কি না। তাদেরও তো টিকে থাকতে হবে, এটা তো একটা যুদ্ধের মতো। এটা তো এক ধরনের শ্রেণিসংগ্রামে পরিণত হচ্ছে। মানে যদি গণমাধ্যমের ভেতরে অভ্যন্তরীণভাবে যেসব শ্রেণি থাকে, সেগুলোর আলাপ করা হয়। এই শ্রেণির তো একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করার সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে। এটাও কারো নিয়ন্ত্রণের কারণে হয়নি, এটা টেকনোলজি নিয়ন্ত্রণের কারণে হয়েছে। টেকনোলজি তৈরি করেছে নতুন একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভূমিকাটা পালন করতে পারবে কি না, আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, অনলাইন সাংবাদিকতার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে উন্নত করার সম্ভাবনা বেশি। সেই অনলাইন ব্যবহারকারীরা যদি গরিব মানুষের দিকে তাকায়, তাহলে গরিব মানুষের সঙ্গে অনলাইনের একটা সম্পর্ক হতে পারে। কারণ, যারা টেলিভিশন বা পত্রপত্রিকার মধ্যবিত্ত, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কিন্তু উপরের দিকে, অর্থাৎ বড়লোকের। কারণ, বড়লোকরা তাকে চালায়, বেতন দেয়। আমরা মধ্যবিত্তরা বড়লোকের ওপর নির্ভশীল। অনলাইনে তো বড়লোক নির্ভশীলতা তুলনামূলকভাবে কম। সে যদি গরিবের কথা তুলে আনতে পারে, তাহলে গরিবের সঙ্গে মধ্যবিত্তের একটা সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। সেটা হবে কি না আমরা জানি না। আগামীতে দেখা যাক।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক।