স্বাধীন ভাবনা
আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব
কিছু দিনের মধ্যে স্বাধীনতার ৪৫ বছর হবে। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অনেক কিছু করার কথা ছিল। আমরা জানি, স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, সেগুলোকে ধারণ করে ৭২-এ আমাদের যে সংবিধান হয়েছিল সেখানে চারটা মৌলিক নীতি ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে আমরা শোষণমুক্ত, সমতাধর্মী সমাজ প্রতিষ্ঠা করব। ধর্মীয় হানাহানি থাকবে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাদের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি সবকিছুর মধ্যে মিল আছে। এটাই আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে একতাবদ্ধ করেছিল। এ জন্য আমরা এক, একক জাতি।
এখন অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে যে অর্জন, এগুলো নিঃসন্দেহে এক। কিন্তু এটি আরো বেশি হতে পারত। আমরা জানি, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই কাজটি করে। এর ফলে আমরা পিছিয়ে গেছি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, দ্বিতীয় বিপ্লব করতে। দ্বিতীয় বিপ্লবটাই ছিল অর্থনৈতিক বিপ্লব। বাকশালের মধ্য দিয়ে তিনি কৃষির আধুনিকায়ন, সমবায়িকীকরণ করতে চেয়েছিলেন। পরীক্ষামূলকভাবে ১২৫টি উপজেলায় বহুমুখী সমবায় করতে চেয়েছিলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদন বাড়ানো। জমি জাতীয়করণ করা নয়। সবাই মিলে যখন কাজ করবে, তখন ফসলের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে উঠবে। বড় আকারের চাষাবাদে যদি না যাওয়া যায়, তাহলে আমাদের দেশে উৎপাদন বাড়ানো খুব কঠিন ব্যাপার।
এ থেকে এটা বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে উৎপাদন বাড়লেও প্রত্যাশিত হারে বাড়াতে পারেনি। বিশেষ করে ৮০ ও ৯০-এর দশকে। একমাত্র ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন আবার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়। এর আগে বলা দরকার, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশে শিল্পায়ন হবে, মৌলিক ভারী শিল্প গড়ে তোলা হবে। এ কাজ শুরুও করেছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই স্টিল মিল গড়ে তুলেছিলেন তিনি জাপানিদের সহায়তায়, ঘোড়াখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন তিনি সোভিয়েতদের সহায়তায়। আর একটি ব্যাপার গোটা দেশের গণতন্ত্রায়নের জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের অভিজ্ঞতার আলোকে দেশকে ৬৪টা জেলায় ভাগ করেছিলেন। এবং প্রতিটি জেলায় জনগণ নির্বাচিত একজন গর্ভনরের অধীনে গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত হবে এটাই তিনি বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। ওই যে চারটা লক্ষ্যের একটা গণতন্ত্র এটার মাধ্যমে।
সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্যই এই যে কৃষি উৎপাদন, শিল্পায়ন। তিনি আমদানি বিকল্প শিল্পনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এটা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকার বাদ দেয়। আর এই বাদ দেওয়াই আমাদের জন্য কাল হয়েছে। এ জন্য আমাদের এখন মৌলিক ভারী শিল্পের পণ্য যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানি করতে হচ্ছে। এটার জন্য আমাদের প্রচুর আমদানি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। না হলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার ফলে কম্পিউটার সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি থেকে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণভাবে তুলে নেয়। তার আগে দুইশ, তিনশ শতাংশ শুল্ক ছিল। ফলে আমাদের প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেনি। সে সময় বিকাশ ঘটতে শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে আবার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে তারা তেমন কিছু করতেই পারেনি। ২০০৮-এ আবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সেটার ফল আমরা পেয়েছি। এরই মধ্যে আমাদের দেশে প্রোগ্রামার, বিভিন্ন সফটওয়ার কোম্পানি, এদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, কাজও বেড়েছে। সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদের হেডকোয়ার্টারে আইটি সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ গড়ে তোলা হচ্ছে। ২৭ হাজারের মতো স্কুলকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯ হাজার করেছিলেন।
এই কাজগুলো বলে দেয়, আমরা অনেকটাই আশাবাদী। দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু শিক্ষাকে সাংঘাতিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেটা হলো, বাংলাদেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ খুদার নেতৃত্বে ৭২-এ শিক্ষা কমিশন করেছিলেন তিনি। তারা পরের বছরই বঙ্গবন্ধুকে রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছিল। সেটা বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল। ওই শিক্ষা কমিশনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা মৌলিক শিক্ষা অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে চেয়েছিল। এটা হলো ফাংশনাল এডুকেশন। এটা যদি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করে যেতে পারতেন, বাংলাদেশ ৮০-এর দশকেই উন্নত দেশে পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
সামরিক শাসকরা এসে পরিকল্পনাকে অবহেলা করেছে। তারা স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে এগিয়েছে। যে জন্য আমাদের বিশাল সময় নষ্ট হয়েছে। সম্পদের, বিদেশি সাহায্যের অপচয় হয়েছে। চুরি হয়েছে, আত্মসাৎ হয়েছে ইত্যাদি। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও আমরা বলি, ৮০ ও ৯০-এর দশকে আমরা দেখেছি ঋণ নিয়ে কেউ ফেরত দেয় না। খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। প্রাইভেটাইজেশনের নামে লাভজনক কল-কারখানাগুলোকে সামরিক সরকাররা বেসরকারি খাতে দিয়ে দিয়েছে। এগুলো সাংঘাতিক ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমরা যদি ভালোভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে চালাতাম, দুর্নীতিমুক্তভাবে, আধুনিকায়ন করে তাহলে তো উৎপাদন বাড়ত। ক্ষতির কিছু ছিল না।
আর আমদানি বিকল্প শিল্পনীতি যদি চালিয়ে যেত, তাহলে বাংলাদেশ থেকেই গাড়ি-ঘোড়া, জাহাজ ইত্যাদি রপ্তানি হতো। আজকে আমদানি আমাদের করতেই হতো না। উল্টো আমাদের এই যে বিশাল জনসংখ্যা এটাকে আমরা জনশক্তিতে পরিণত করতে পারতাম, আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে। যে কাজটা এখন শুরু হয়েছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে আমাদের। আমাদের সরকার এখন সঠিক পথেই আগাচ্ছে। ছোটখাটো কিছু দুর্নীতি, এটাসেটা সমস্যা আছে। এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠলে আমি মনে করি উন্নত দেশে পরিণত হতে আমাদের ১৯৪২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। ২০৩০ সালের মধ্যেই আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।