স্বাধীন ভাবনা
‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫তম বছর চলছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ আবর্তিত হয়েছে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে, পার হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি প্রজন্ম। এ সময়ে যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তাঁরা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করেন হৃদয়ে। তাঁদেরও রয়েছে কিছু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তেমনি কিছু তরুণের চিন্তাভাবনাকে সংকলিত করেছেন হাসানুজ্জামিল মেহেদী।
ম. দিদার
৪৩তম আবর্তন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
স্বাধীনতার লক্ষ্য যদি হয় ভৌগোলিকভাবে একটি ভূখণ্ড প্রাপ্তি, তবে আমরা সেটা অনায়াসে পেয়েছি। কিন্তু যাঁরা দেশকে স্বাধীন করেছেন, তাঁদের প্রত্যাশা কি তাই ছিল? স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমাদের এই হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। আমরা পেরেছি কি বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে? দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা কেমন, তা আমাদের কারো আজানা নয়। বিজয়ের ৪৫ বছরে এসে মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে, তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা, সেখানে আট কোটি মানুষ আজ দারিদ্র্যঝুঁকির মধ্যে বাস করে।
বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার কৃতিত্ব কোনো বিশেষ ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর একার নয়। সামরিক-বেসামরিক নির্বিশেষে সব পেশা ও বয়সের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। শরীরের রক্ত ঝরানো ছাড়াও তাঁদের সহ্য করতে হয়েছিল বহু জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের অব্যক্ত যন্ত্রণা। কিন্তু এখনো ‘দিকে দিকে শকুনিরা ফেলিছে নিঃশ্বাস’। একটি মহল এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদীতে ঘাঁটি বানাতে চায়। আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নয়; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। গত চার দশকেও এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আজ আমাদের প্রত্যেকের উপলব্ধির সময় এসেছে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।’
মোহাইমিনুল ইসলাম আরাফাত
শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন
পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব বৈষম্য সহজেই দৃশ্যমান ছিল, তার মাঝে অন্যতম হলো অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার বিস্তর ফারাক। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতির স্বপ্ন প্রত্যক্ষ্যভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মসৃণ-অমসৃণ পথ পেরিয়ে সেই স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হতে পেরেছে, সেটা অবশ্যই আলোচনা সাপেক্ষ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী নাজেহাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে শক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর কর্মমুখী শিক্ষার দরকার ছিল, যা টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্ভব হয়নি। পরে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বৈদেশিক বিনিয়োগের পাশাপাশি বিঘ্ন করেছে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে। তার পরও ব্যাপক পরিমাণ অর্ধদক্ষ জনশক্তি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রণোদনা আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার পরিপ্রেক্ষিতে একসময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’খ্যাত বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি। বিশেষ করে ঔষধশিল্পে, গার্মেন্ট খাতে আর জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসার দাবিদার।
বর্তমান সময়ে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাকে সমর্থনযোগ্য। তা ছাড়া অর্থনীতিতে বেকারত্ব আর মুদ্রাস্ফীতির যে বিপরীত সম্পর্ক বিদ্যমান, তার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন জরুরি। দেশের অর্থনীতিতে জনগণের ব্যপক অংশগ্রহণের জন্য কর্মমুখী শিক্ষা আর আউটসোর্সিংয়ে আগ্রহ তৈরির মাধ্যমে মধ্যম শ্রেণির কর্মজীবীর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আর ‘স্বাধীনতা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ও সুবিধা জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সরকারি, জাতীয় আর বহুজাতিক কোম্পানিতে বাংলাদেশি ও বৈদেশিক কর্মীদের নিয়োগ, পদায়ন, পদান্নতির নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ও তা সমঅধিকার রক্ষা করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
সা'দ শারীফ
শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক সব সময়ই থাকে। বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে প্রাপ্তির জন্য যে চেতনা জাগ্রত হয়, তাকেই বলা যেতে পারে প্রত্যাশা। তাই প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি শব্দটা সরাসরি যুক্ত। প্রাপ্তিটা চেতনাগত নয়, তা বাস্তব। হাতেনাতে কিছু পাওয়াটাই প্রাপ্তি। একটা পেলে আরেকটা পাওয়ার প্রত্যাশা জাগ্রত হওয়া মানুষের সহজাত। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, ঘুরতে গিয়েছিলাম দেশের প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলে। কথা বলছিলাম কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তখন ধানের দাম সামান্য কম ছিল। দুজন সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এখন দাম কিছুটা কমেছে। গতবার তো ভালো দাম পেয়েছেন। কৃষি উপকরণে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় তারা যা বলতে চাইলেন তার সারাংশ হলো, উৎপাদন বেড়ে যাওয়া এবং দাম পাওয়া তাদের পরিশ্রমের ফল। আর দাম না পাওয়াটা সরকারের নীতিগত ত্রুটির ফল। অর্থাৎ ভালো প্রাপ্তির কৃতিত্ব নিজের আর অপ্রাপ্তির দোষটা সরকারের। প্রত্যাশার ক্ষেত্রে আরও বলা যায়, যিনি চেয়ারে বসে ঘুষ খান, তিনিও প্রত্যাশা করেন, রাষ্ট্রে যাতে দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজ না থাকে। উল্লিখিত দিকগুলো বিবেচনা করে ৪৫ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে পর্যালোচনা করলে ভিন্ন চিন্তার অবকাশ থাকে প্রত্যাশা যেমন অনেক, অপ্রাপ্তিও অনেক। তাই অপ্রাপ্তির তালিকা তৈরি করতে চাই না। প্রাপ্তির জায়গা থেকে আমরা বারবার আশাবাদী হতে চাই।
শরীফুল ইসলাম শরীফ
শিক্ষার্থী, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি
নতুন নিশান উড়িয়ে, এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। হ্যাঁ, শামসুর রাহমানের কাব্যিকতায় আমরাও পেয়েছি মহান এক স্বাধীনতা। বাংলাদেশ যার প্রতিচ্ছবি। মায়াবী তার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি। অপরূপ স্বাপ্নিক চাহনি। আকাশে অচীন পাখির মিষ্টি কোলাহল। ইশ, কী রূপের জাদু তোমার সারা অঙ্গজুড়ে! মুগ্ধতায় কবি গাইতে ভোলেননি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সে যে আমার জন্মভূমি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মুক্তিকামী বাংলা মায়ের দামাল সন্তান এবং বীরাঙ্গনাদের। পেটে খাবার নেই, চোখে ঘুম নেই, গায়ে জোর নেই, তবুও দেশকে হানাদারমুক্ত করতে অসম্ভব রকম দৃঢ় প্রত্যয় ছিল তাঁদের। একেই বলে দেশপ্রেম।
৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি তাক লাগানো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এসব ইতিহাসকে ছাপিয়ে স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর যখন একজন বাংলাদেশি নাগরিকের প্রাপ্তি-প্রত্যাশার বিষয়টি সামনে আসে, একটু হকচকিত হই! নড়েচড়ে বসতে ইচ্ছে হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে লাল-সবুজের মোড়কে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামটি অর্জন কম কিসের? স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারও গর্ব করার মতো। নিউ জেনারেশনের মাঝে দেশকে ভালোবাসার প্রবণতাও দৃশ্যমান অর্জন বলতে হবে। প্রত্যাশার জায়গায় আমি খানিকটা উচ্চাভিলাষী! উন্নয়নশীল নয়, উন্নত দেখতে চেয়েছিলাম। ভিনদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপরীতে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্যের আবদার ছিল। যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ-রেষারেষি, পেশিশক্তি নয় থাকবে গণতন্ত্রের দাপট, বুদ্ধির প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রের সংকটপূর্ণ অবস্থায় পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বনবাস আর মেধার সঠিক মূল্যায়ন দেখব ভেবেছিলাম। অথচ কী দেখার কথা কী দেখছি? এরপরও আমি হতাশ নই। আস্থা রাখি তরুণ প্রজন্মের ওপর। স্বপ্ন দেখি আলোকিত বাংলাদেশের।