কাণ্ডারী হুঁশিয়ার
কে নজরুল কেন নজরুল
কে নজরুল? আর কেনই বা নজরুল? সচেতন কোনো বাঙালির পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন বলে মনে হয় না। তবু এই প্রশ্ন উত্থাপনের পেছনে আছে নজরুলকে নতুন করে বোঝার আকাঙ্ক্ষা, আছে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবনের বাসনা। কে নজরুল? সহজ উত্তর-হাজার বছরের বাঙালির ঋদ্ধ ইতিহাসের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বাঙালির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। একজন স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে একটি জাতিকে জাগিয়ে তোলেন যিনি, তিনিই নজরুল। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রবলপ্রাণ বিদ্রোহীর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার তূর্যবাদক এক সেনানির নাম নজরুল, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক সংহত রূপের নাম নজরুল। স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দেশবাসীকে জাগাতে চান যিনি, প্রেমের অধরা মাধুরীর কথা কবিতা ও গানে শোনান যিনি, মানবতার পক্ষে দাঁড়ান যিনি, শাস্ত্রাচার-লোকাচার আর সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে কলম ধরেন যিনি-তিনিই নজরুল। কতভাবেই তো নজরুলের পরিচয় তুলে ধরা যায়।
কাজী নজরুল ইসলামকে স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষ হিসেবে দেখতেই আমি ভালোবাসি। জন্মের পর ১১৫ বছর অতিক্রান্ত, তাঁর নীরব হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় ৭৫ বছর, মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি প্রায় ৪০ বছর, তবু বাংলাভাষী মানুষের কাছে নজরুল ইসলামের অব্যাহত প্রভাব দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তাঁর সাহিত্যকর্মের পরিমাণ বিপুল, লিখেছেন চার হাজারের অধিক গান, সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা, সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন রাজনীতিতে, সংযোগ ছিল মানবকল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। দ্বিমাত্রিক এই প্রয়াস ও উদ্যোগের কথা স্মরণে রেখেই আমি দেখতে চাই, ভাবতে ভালোবাসি নজরুলকে।
যাকে বলব বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভা, নজরুল তার উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ছড়া, ব্যক্তিগত রচনা, চিঠিপত্র, অভিভাষণ, সংগীত-কোন রূপকল্পে না লিখেছেন নজরুল? রবীন্দ্রনাথের প্রবল পরাক্রমের সময় আবির্ভূত হয়েও বাংলা কবিতায় একটা স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণে সমর্থ হয়েছেন নজরুল। আমাদের কবিতার ধারায় তিনিই প্রথম শিল্পী, যিনি রাজনীতিকে রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে। রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশি কবিদের সমকালে কবিতা লিখেও তিনি মুহূর্তেই চিনিয়ে দিলেন তাঁর প্রাতিস্বিক স্বর। নজরুলের দ্রোহচেতনা সঞ্চারিত হলো ঘুমন্ত এক জাতির মর্মমূলে। কবিতাও যে হতে পারে জাগরণের শক্তি-উৎস, নজরুলের কবিতা পাঠেই তা প্রথম জানল বাঙালি জাতি। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জয় পতাকা উড়িয়ে বাংলা কবিতায় তিনি আবির্ভূত হলেন বন্ধনমুক্ত প্রমিথিউসের মতো। কবিতায় নজরুল উচ্চারণ করেছেন মানবতার জয়, কামনা করেছেন প্রান্তবাসী নিম্নবর্গের উত্থান। তাঁর কবিতায় পরাক্রমশালী বিদ্রোহীর পাশেই আছে কুলি-মজুর-কৃষক-শ্রমিক আর ধীবরের দল, আছে সাঁওতাল-গারো-ভিল জনগোষ্ঠী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তিরিশের কবি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যেখানে উচ্চারণ করেন-'সহে না সহে না আর জনতার জঘন্য মিতালি', নজরুল সেখানে উচ্চারণ করেন-'চাইনে সুর, চাই মানব'। ফ্যাসিবাদের উগ্র আগ্রাসনের মধ্যে বাস করেও রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন, 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ', তেমনি অভিন্ন চেতনায় নজরুলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়-'আমি আজো মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি। মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি। এই ধূলিমাখা, অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে।' এই মানবতাবাদী চেতনাই কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কেন্দ্রীয় সুর। সুস্পষ্ট মানববন্দনা সমকালের সাহিত্যধারায় নজরুলকে স্বকীয় মাত্রায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কবিতায় নজরুল মানুষকে বিবেচনা করেছেন সাম্যবাদীর দৃষ্টিতে, কোনো ভেদচিন্তা সেখানে শিকড়ায়িত হয়নি।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা নজরুলের সাহিত্যকর্মের বিশিষ্ট লক্ষণ। তাঁর কালের অন্য কবিদের সাম্প্রদায়িক বলছি না, তবু এ কথা জোরের সঙ্গেই বলব- কাজী নজরুল ইসলামই বাংলা ভাষার প্রথম এবং শেষ অসাম্প্রদায়িক কবি। দ্বিমাত্রিক ঐতিহ্যবোধে ঋদ্ধ ছিল নজরুলের সৃষ্টিশীল মানস। জন্মসূত্রে ভারতীয় উত্তরাধিকারকে তিনি গ্রহণ করেছেন আপন উত্তরাধিকার হিসেবে; অন্যদিকে ধর্মবিশ্বাস-সূত্রে তিনি অর্জন করেছেন পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। দ্বিমাত্রিক এই ঐতিহ্যচেতনা শিল্পী নজরুলের মানসলোকে উপ্ত করেছে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ। নজরুলের সৃষ্টিচৈতন্যে সম্প্রদায়নিরপেক্ষ এই চেতনা সদা সক্রিয় থাকার কারণেই উচ্চারিত হয় এমন প্রত্যয়দীপ্ত চরণ : "অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ/কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ/'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র।" (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার) প্রচলিত ও সনাতন ধর্মচেতনার ঊর্ধ্বে উঠে কবিতায় মানবধর্মের জয়গান গেয়েছেন নজরুল। বস্তুত, মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল, স্বদেশের স্বাধীনতা। তাই হিন্দু বা মুসলমান নয়, বিদ্রোহের জন্য মানুষের কাছেই ছিল তাঁর উদাত্ত আহ্বান। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতন আর সাম্প্রদায়িক ভেদ, নেই আদি-নৃগোষ্ঠীর প্রতি কোনো তুচ্ছতাবোধ।
নারীকে প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না দেখে নজরুল দেখেছেন সামাজিক লৈঙ্গিক তথা জেন্ডার দৃষ্টিকোণে। ফলে অতি সহজেই তিনি কবিতা-কথাসাহিত্য-গানে নারীর ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়েছেন, নারীচিত্তে দেখেছেন বিপুল শক্তির সমাবেশ। 'সাম্যবাদী' কবিতায় তিনি ঘোষণা করেছেন নারীর বিপুল মহিমা, 'মৃত্যুক্ষুধা'র মেজ বৌকে দিয়েছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আর রাক্ষুসী গল্পের বিন্দিয়াকে তো দিয়েছেন অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব-পরশ।
হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ধারায় কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃত প্রস্তাবেই একজন মৌলিক লেখক। নজরুলের নানা মাত্রিক ভাবনা বর্তমান সময়েও তাঁর কালের মতোই সমান প্রাসঙ্গিক। অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতাই নজরুল-সাহিত্যের কালোত্তীর্ণতার কেন্দ্রীয় উৎস। আমরা আমাদের প্রয়োজনে নজরুল ইসলাম ও তাঁর ভাবনাকে কীভাবে ব্যবহার করতে পারি-সেটাই হওয়া উচিত এ কালে নজরুলচর্চার মৌল বিষয়। আমাদের ব্যক্তিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই নজরুল হয়ে উঠুক প্রতিদিনের চর্চার বিষয়- এটাই আমাদের আত্যন্তিক আকাঙ্ক্ষা।
বিশ্বজিৎ ঘোষ : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়