ইতিহাস
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা হয় যশোরে
একাত্তরে মিত্রবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উভয়ের কাছেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেসময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তর ছিল কলকাতায়, যা যশোর শহর থেকে মাত্র ১১০ কিলোমিটার দূরে। এ অঞ্চলের একমাত্র বিমান ঘাঁটিটিও ছিল যশোরে। আর সে কারণেই ব্যাপক শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে যশোরকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে পাকিস্তানিরা। এ ঘাঁটি এতটাই দুর্ভেদ্য ছিল যে পাকিস্তানিরা এটিকে ‘প্রাচ্যের স্টালিনগ্রাড’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ব করত।
এ রকম ঘাঁটি দখলে নিতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী মরণপণ লড়াই শুরু করে ২১ নভেম্বর। ১৬ দিন ধরে চলা ভয়াবহ এক যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদাররা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ যুদ্ধ ঠাই পায় ইতিহাসে। মেশিনগান, ট্যাংক, কামান, এমনকি বিমান পর্যন্ত ব্যবহৃত হয় এ যুদ্ধে। যুদ্ধের সব রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর হানাদারদের সাথে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর হাতাহাতি বা মল্লযুদ্ধ পর্যন্ত হয়। ইতিহাসে এ রকম যুদ্ধের কথা লেখা আছে খুব কমই।
প্রায় ১৬ দিন ধরে চলা ভয়ংকর এ যুদ্ধের পর ৬ ডিসেম্বর রাতে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে পালিয়ে যায় হানাদাররা। দেশের প্রথম জেলা হিসেবে হানাদারমুক্ত হয় যশোর।
মুক্ত যশোরে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর বেদনা। ৭ ডিসেম্বর সকালে যশোরে আসেন ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর ও মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবর সিং।
ওই দিনই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় থাকা প্রবাসী সরকার ওয়ালিউল ইসলামকে যশোর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম জিকু, শাহ হাদীউজ্জামান, অশোক রায় ও নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক যশোরের চৌগাছা উপজেলার মাসিলা সীমান্ত দিয়ে যশোর শহরে পৌঁছান। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের যে কটি ঘটনা যশোরবাসীকে গর্বিত করে, তেমনই আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে যায় এই ১১ ডিসেম্বর। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে। ওই জনসভায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় দেশের জন্য আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আর ধ্বংস নয়, যুদ্ধ নয়। এ মুহূর্তে কাজ হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা।’
জনসভায় প্রধানমন্ত্রী যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম এবং কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাঞ্চন ঘোষালকে নির্দেশ দেন, আইনশৃঙ্খলার যেন অবনতি না ঘটে। একই সঙ্গে তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। অপরাধী যে-ই হোক, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন’।
জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, রওশন আলী, মোশাররফ হোসেন, তবিবর রহমান সরদার, এমআর আকতার মুকুল, লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীরা যশোর-বেনাপোল সড়ক ধরে কলকাতায় চলে যান।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ জনসভার খবর সংগ্রহ করতে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার গিল, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি এস এইচ সানবার্গ, বালটিমোর সান, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বহু খ্যাতনামা পত্রিকার প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। পরের দিন ওই সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভার খবর।
লেখক : যশোর প্রতিনিধি