শ্রদ্ধা
বিস্মৃত এক শহীদ বুদ্ধিজীবীকে বঙ্গবন্ধুর স্মরণ
স্বাধীনতা এসেছে, পেড়িয়েও গেছে ৪৫টি বছর। এই সুদীর্ঘ দিন-রাতগুলো একটি পরিবারের কাছে অব্যক্ত বেদনার উপাখ্যান হয়েই রইল। জাতির পিতা যাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় তাঁকে কেউ মনেও করে না, মুখ ফুঁটে বলেও না তাঁর আত্মত্যাগের কথা। দেশ দূরে থাক তাঁর নিজ জেলার মানুষও তাঁকে স্মরণ করেনি একটি দিনের জন্যও।
যাঁকে নিয়ে এই লেখা তিনি যশোরের মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ।
এই মেধাবী দেশপ্রেমিকের জন্ম আর স্কুল-কলেজের সুবর্ণসময় কেটেছে পৈত্রিক ঠিকানা মানিকগঞ্জ শহরের গংগাধরপট্টি এলাকায়। লোভনীয় সরকারি চাকরিকে উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। অর্থনীতির শিক্ষক হলেও তাঁর চেতনা আর মননজুড়ে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সুগভীর এক স্বপ্ন। অন্য দশজনের মতো এই স্বপ্নের কথা মনের গভীরে নীরবে-নিভৃতে লালন করেই দায় শোধ করেননি। ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন ছাত্র-জনতার মাঝে। লিখেছেন, বলেছেন, প্রাণখুলে প্রাণের কথা, স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা, দ্রোহের কথা। ৬৯,৭০,৭১-এর উত্তাল মার্চে তাঁর ভূমিকা ক্ষুব্ধ করেছিল পাকহানাদার আর তাদের দোসরদের। তারা মনেও রেখেছিল, অপেক্ষায় ছিল অনুকূল সময়ের। বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হয়নি ঘাতকদের। ২৫ মার্চের কালরাতে শুরু হওয়া গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক হত্যা কেবল রাজধানীতেই আবদ্ধ থাকেনি। আবদ্ধ থাকেনি জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের মাঝেই। হানাদারদের হিংস্র থাবার বিস্তার ঘটেছিল রাজধানীর বাইরেও।
যশোর শহরের নিয়ন্ত্রণ তখন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে, মাঠে নেমেছে তাদের এ দেশীয় দোসররা। দিনটি ছিল ১৯৭১-এর ৪ এপ্রিল। ঘাতক পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা ঘিরে ফেলে অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিনের যশোর শহরের বাসা। বাড়ি থেকে তুলে এনে বাড়ির আঙিনাতেই গুলি করে হত্যা করা হয় এই বুদ্ধিজীবী শিক্ষককে। বাড়ির গোপন জায়গায় লুকিয়ে থেকে গুলির শব্দ শুনেছিলেন তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র শিশু সন্তান। এই নির্মম উপাখ্যানের ইতি এখানেই।
নয় মাসের রক্তনদী আর যুদ্ধজয়ের ইতিহাস সবার জানা। পাকিস্তানের জল্লাদখানা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন দেশের হাল ধরেন তিনি। চারিদিকে গোপন ষড়যন্ত্র, অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও জাতির জনক খোঁজ নিতে ভুলেননি দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকরা সূর্যসন্তানদের।
১৯৭২ সালের জুলাই মাস। স্বামী হারানোর শোকে আচ্ছন্ন সিরাজ উদ্দিনের পত্নী তখন মানিকগঞ্জে। মানিকগঞ্জের মহকুমা প্রশাসকের কাছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি চিঠি আসে। সেই চিঠিতে শহীদ অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা বেগমকে বোন সম্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেন,
‘প্রিয় বোন,
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি।
এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যিই আপনি ধন্য হয়েছেন।’
এই পত্রে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শহীদ সিরাজ উদ্দিনের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়।
এ পর্যন্তই। এরপরই থেমে যায় সব বাস্তবতা। শহীদ অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিনের পরিবারের কাছে রাষ্ট্র কিংবা সরকারি স্বীকৃতি বলতে যা বোঝায় তা ওই একটি পত্রের মাঝেই আটকে আছে গত ৪৪টি বছর। এরপর আর কোনো সরকার, আর কেউ, অন্য কোথাও শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিনের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দূরে থাক, শহীদ হিসেবে নামটুকুও স্বীকার করেনি। না পত্রিকা, না টেলিভিশন, কেউ না। এমনকি এই সূর্যসন্তানকে তাঁর নিজ জেলা মানিকগঞ্জেও কেউ আজো একটি দিনের জন্য স্মরণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস, লেখালেখি, বক্তৃতাতেও কেউ তাঁকে আনেনি।
শহীদ সিরাজ উদ্দিনের মেঝভাইয়ের ছেলে মানিকগঞ্জের বিশিষ্ট আইনজীবী আসাদুজ্জামান আসাদ দুঃখ করে বলেন, ‘আমার চাচার এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা সামান্যতম কোনো আর্থিক, বৈষয়িক সুবিধা রাষ্ট্র কিংবা সরকারের কাছে চাই না, আমাদের পরিবারের তার প্রয়োজনও নেই। আমরা শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমাদের চাচার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটা চাই। চাই ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটা থাকুক। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে, আমার শহীদ চাচার একমাত্র সন্তানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক চেষ্টা হয়েছে, স্বীকৃতি মেলেনি।’ শহীদ সিরজ উদ্দিনের একমাত্র সন্তান সাইদ হোসেন অভিমানে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতেই রাজি হননি ।
শহীদ অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিনের মেজো ভাই মরহুম জালাল উদ্দিন যক্ষের ধনের মতো বছরের পর বছর আগলে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর লেখা সেই চিঠিটা। তাঁর মৃত্যুর পর পরম মমতায় ওই চিঠিটা আগলে রেখেছেন অ্যাডভোকেট আসাদ। এদের কাছে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত ওই চিঠিটাই একমাত্র দলিল। যা হারিয়ে গেলে সব মুছে যাবে, মুছে যাবে অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিন নামের কেউ এই দেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১-এ নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছিলেন।