আলতাফ মাহমুদের কন্যার স্মৃতি
বাবা ছিলেন গণযোদ্ধা
বাবার স্মৃতি তো নেই উনাকে আমি পরে জেনেছি, শুনে জেনেছি। আলতাফ মাহমুদকে যদি কেউ ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জানতে চাই তাহলে আমি বলব উনি একজন গণমানুষের শিল্পী ছিলেন এবং গণমানুষের যোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ক্রাকপ্লাটুনদের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন একদম সরাসরি। সেখানে আমার মনে হয়েছে যে উনি কখনোই একবারও দ্বিধাবোধ করেননি দেশের জন্য, দশের জন্য, কখনো পিছনে পা ফেলে ঘুরে চলে যাননি। সব সময় এগিয়েই গেছেন। উনি আসলে প্রচণ্ড রকমের সাহসী মানুষ ছিলেন। এটা শুধু যে একাত্তরের পটভূমি তা না। আগেও তার অনেক ঘটনা আছে। তাঁর বিশাল আত্মত্যাগের কাহিনীগুলো যখন আমি পড়ি তখন আমার কাছে মনে হয় যে, যুগে যুগে এ রকম আলতাফ মাহমুদরা ফিরে আসুক, বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশকে রক্ষায়, বাংলাদেশের যেকোনো আন্দোলনে তাই আমি আলতাফ মাহমুদের চেহারা খুঁজে ফিরি।
আলতাফ মাহমুদ হলেন সেই মানুষ যিনি ক্লাস এইটে থাকতে নিজের বাবার বিরুদ্ধে মিছিল করে ছিলেন ১৯৪৭ সালে। তখনই তার নামে হুলিয়া হয়েছিল। মিছিল প্রতিবাদ করার জন্য। সেই আলতাফ মাহমুদকে যখন আমি খুঁজতে গিয়ে ৫২-এর আন্দোলনের পরে যখন পাই শুধু যে একুশের গানের সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদ তা কিন্তু নয়। আসলে আলতাফ মাহমুদ সব সময় পথে ঘাটে মাঠে থেকেছেন। উনি সব সময় জনগণের সঙ্গে থেকেছেন। যেকোনো অনুষ্ঠানে একাত্তরের আগে যখন আমি বিভিন্ন প্রতিবাদ, ১৯৬৬ সালের আন্দোলন বলেন, ১৯৬৯ সালের আন্দোলন বলেন- এগুলাতে শুধু যে উনি গান অনুশীলন করেছেন তা নয়। বিভিন্ন মিছিলে উনি মঞ্চ সাজিয়েছেন, প্ল্যাকার্ড করেছেন, নিজ হাতে প্ল্যাকার্ড লিখতেন, ফেসটুন লিখতেন এবং সব সময় মিছিলের অগ্রভাগে থাকতেন । তাঁর অবস্থান ছিল সবখানে। সেখান থেকে যখন ঘুরতে ঘুরতে আলতাফ মাহমুদকে খুঁজতে যাই তখন আমি অবাক হই। পরবর্তী সময়ে যখন তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিজের নামটা প্রকাশ করলেন, তখনো কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও সব রকমের আন্দোলনে আলতাফ মাহমুদ ছিলেন।
আলতাফ মাহমুদ এমন একজন মানুষ ছিলেন যার তুলনা তিনি নিজেই। কৃষক, মজুরদের যে আন্দোলন সেখানেও তিনি বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে গামছা দিয়ে হারমনিয়াম বেঁধে হেঁটে হেঁটে গান গেয়ে বিভিন্ন আন্দোলন প্রতিবাদ করতেন। সবার সাথে মিছিলে যেতেন। আলতাফ মাহমুদ এই ধরনের মানুষ ছিলেন। নিজের বাবাকে ১৯৪৭-এর পরে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। বরিশাল মুলাদি থেকে ম্যাট্রিকের পর উনার বাবার সঙ্গে রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে বিরোধ হওয়ায় তার বাবার ওপর রাগ করে এক কাপড়ে বাবা যখন আমার দাদাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন, তখন উনি বলেছিলেন, ‘তোমার (দাদার) মৃত্যুর পর আমি আবার আসব আমার বাড়িতে।’ উনি আসার সময় একটা কাঁথা আর একটা বেহালা নিয়ে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। পরে ধূমকেতু সঙ্গীতগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হয়ে সেখানে নাজমুল হক, তারপর আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবদুল লতিফ প্রমুখ বাবাকে সাহায্য করেছিলেন বিভিন্ন ভাবে। আমি যেটা শুনেছি বাবা কেরোসিন বিক্রি করেও নাকি নিজের জীবন চালিয়েছেন, খেয়েছেন। এই ধরনের মানুষিকতা ছিল আলতাফ মাহমুদের।
অনেক কিছু করে ফেলতে হবে অথবা বিশাল কোনো অর্জনের আশায় ছিলেন না বাবা। একুশের গানটা যে উনি করেছিলেন সেটাও মনে হয় জানতেন না যে কত বড় একটা মাইলফলক উনি রেখে যাচ্ছেন বাংলাদেশের জন্য। এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে যত দিন বাংলাদেশ থাকবে। তত দিন ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারণ একাত্তরে যখন তার অ্যাক্টিভিটিসগুলো আমি পড়েছি আলতাফ মাহমুদ মার্চের প্রথম থেকেই পেট্রোল জমাতেন নিজের বাথরুমে বোমা তৈরি করবেন এই জন্য। এই ছোট জিনিসগুলো থেকেই উনি যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। নিজের বাসাটাকে দুর্গ বানিয়ে ফেললেন। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন, এখানে আশ্রয় নিতেন। এখানে অস্ত্র থাকত। এখান থেকে অস্ত্র চলে যেত মেলা ঘরে। এই ধরনের জিনিস থেকেই এককথায় আমি ওনাকে একজন সাধারণ গণযোদ্ধা হিসেবেই দেখি, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই দেখি। আমি কখনো আলতাফ মাহমুদকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে দেখি না। উনি যে লেভেলে আসলে যুদ্ধ করেছেন, জীবন চালিয়েছেন, সেই দিক থেকে আমি উনাকে একজন গণযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, গণশিল্পী হিসেবেই দেখি।
শ্রুতিলিখন : সেখ ফয়সাল আহমেদ