শাহজাহানকে টপকে স্ত্রী প্রেমের ‘অনন্য’ নজির বেনজীরের
সাংবাদিকদের কাছে জাতীয় প্রেসক্লাব ‘দ্বিতীয় গৃহ’ বা ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে পরিচিত। আমি ২১ বছর আগে ২০০৩ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হই। ক্লাবটির মেম্বার লাউঞ্জে চায়ের টেবিলে বসে আড্ডা দেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। মাঝেমাঝে দূরের সোফায় চুপচাপ বসে তাঁদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও যুক্তিতর্ক শুনি। একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেন এখন তাঁদের কেউ কেউ অবসরে, কেউবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।
এসব গুণী সাংবাদিকদের দু-একটি ঘটনা বলে মূল প্রসঙ্গে আসি। একবার প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা এলেন। তাঁর কণ্ঠে সরাসরি গান শুনব ভেবে আমাদের বেশ উৎসাহ। নির্দিষ্ট সময়ে রুনা লায়লা মঞ্চে উঠলেন। একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন। তাঁর সুরের মূর্ছনায় পুরো ক্লাব অঙ্গন মাতোয়ারা। ঠিক এ সময়ে প্রবীণ সাংবাদিক ও গীতিকার আহমদ জামান চৌধুরী খোকা ভাই অনুষ্ঠানস্থলে এলেন। খোকা ভাইকে দেখেই রুনা লায়লা গান থামিয়ে মঞ্চ থেকে দ্রুত নেমে এসে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।
অসুস্থ খোকা ভাইকে কয়েকজন সাংবাদিক কোলে করে মঞ্চে তুলে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। পুনরায় গান শুরুর আগে রুনা লায়লা ঘোষণা দিলেন, ‘আমি আজ খোকা ভাইয়ের লেখা গান ছাড়া আর কোনো গান গাইব না।’ আমার যতটুকু মনে পড়ে এরপর তিনি ১৭টি গান গেয়েছিলেন। আমি এর আগে জানতাম না, জনপ্রিয় এসব গান খোকা ভাইয়ের লেখা! এ বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না, মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, চুরি করেছো আমার মনটা.. গানের সাথে যেন সুরের আবেশে মেতে উঠেছিল পুরো প্রেসক্লাব অঙ্গন।
আরেকদিন প্রেসক্লাবের বিশাল টিভিতে ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে- গানটি বাজছিল। টিভি রুমে ওই সময় প্রবীণ সাংবাদিক ও গীতিকার কে জি মোস্তফা ভাইও ছিলেন। গানটি শেষ হতেই সাংবাদিকরা একযোগে কেজি ভাইকে ঘিরে ধরে গানটির তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ওইদিনই জানতে পারলাম- কালজয়ী এ গানটি কেজি মোস্তফা ভাই লিখেছেন।
প্রেসক্লাব লাউঞ্জে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে সম্রাট শাহজাহান আর হাল আমলের বেনজীর আহমেদকে নিয়েও অম্লমধুর বিতর্ক চলছিল। সামনের টেবিলে রাখা জাতীয় পত্রিকাগুলো। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও র্যাবের সাবেক মহপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী জীশান মির্জার সম্পদের বিবরণ।
পত্রিকাগুলো উল্টাতে উল্টাতেই একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলে উঠলেন ‘প্রেমের ভুবনে সম্রাট শাহজাহানকে হারিয়ে শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছেন বেনজীর আহমেদ।’ একটু দূরে বসলেও তাঁদের কথাবার্তাগুলো বেশ স্পষ্টভাবেই কানে বাজছিল। আমি তো রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। বললেন কী তিনি? কোথায় শাহজাহান আর কোথায় বেনজীর? অনেকটা সাহস করেই কাছে গিয়ে শাহজাহানের সঙ্গে বেনজীরের তুলনা করার মৃদু প্রতিবাদ জানালাম।
পিঠে হাত বুলিয়ে জ্যেষ্ঠ ওই সাংবাদিক দুষ্টুমি হাসি দিয়ে আমাকে বললেন, অযৌক্তিক কিছু বললাম? তুমি কি আজকের পত্রিকাগুলো পড়নি। সম্রাট শাহজাহানের অমর প্রেমের কৃতি হিসেবে তৈরি ‘তাজমহল’ সম্পর্কে তুমি কী জান? তাজমহল কতটুকু জায়গার ওপর নির্মিত, তোমার কী কোনো ধারণা আছে?
তখন আমি একটু আমতা আমতা করছিলাম। এ দৃশ্য দেখে ওই সাংবাদিকই উত্তর দিতে থাকলেন। দেখলাম, তাঁর চোখ ও চেহারার অবয়ব ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠছে। তিনি বলতে থাকলেন, সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজের নামে তাজমহল তৈরির জন্য মোট জমি দান করেছিলেন ৪২ একর। এই জমির ওপর দাঁড়িয়েই তাজমহল বিশ্বব্যাপী আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ ওই সাংবাদিক গত ২৬ মে প্রকাশিত ডেইলি স্টার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘দুদকের নথিতে দেখা যায়, বেনজীর ও তাঁর পরিবার ৮৩টি দলিলের মাধ্যমে ১১৪ একর জমি কিনেছে। এর বাইরেও দুদক শুধু বেনজীরের স্ত্রী জীশান মির্জার নামেই ৯১ একর জমির সন্ধান পেয়েছে। সে হিসেবে জীশান মির্জা মমতাজের চেয়েও ভাগ্যবতী, কারণ সম্পত্তি শত একরের কাছাকাছি।’
‘বেনজীরের ক্ষমতার পরশে প্রায় শত একর জমির মালিক হওয়া জীশান মির্জাকে এ সময়ের ‘মমতাজ’ আখ্যা দিলেন জ্যেষ্ঠ ওই সাংবাদিক। ২৭ মের প্রথম আলো পত্রিকার সূত্র উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বললেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে আরও ২৭৬ বিঘা বা ৯১ একর জমির সন্ধান পেয়েছে। এর বাইরে স্ত্রী ও এক মেয়ের নামে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট খুঁজে পেয়েছে। এগুলোর মোট আয়তন ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট।
জীশানকে ভাগ্যবতী উল্লেখ করে ওই সাংবাদিক আরও যোগ করলেন, ‘হিমালয়ের মতো উঁচু, আটলান্টিক মহাসাগরের মতো গভীর আর প্রশান্ত মহাসাগরের মতো বিস্তৃত মন না থাকলে কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রীকে শত একর জমির মালিক বানিয়ে দিতে পারেন না। কাজেই বেনজীরের তৈরি ‘প্রেমের স্থাপনা’ পুরো পৃথিবী কেন, সৌর জগত, মহাজগত এবং গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে চলে যাবে। এ প্রেম অমর হয়ে থাকবে, আকাশের তারা হয়ে জ্বলবে শতাব্দীর পর শতাব্দী।’
পুরো লাউঞ্জে পিনপতন নীরবতা, কারো মুখেই শব্দ নেই। আমার দিকে একটি পত্রিকা এগিয়ে দিয়ে জ্যেষ্ঠ ওই সাংবাদিক বললেন, ‘নাও, এটি পড়ো।’ পত্রিকাটি হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে নিজের আসনে গিয়ে পড়তে বসলাম।