রমজানে যেমন দেখেছি কাশ্মীরকে
রমজান মাসের সেহরি আর ইফতারের আমেজ ওই বৈশ্বিক সংযোগকে আরো বেশি স্পষ্ট করেছে। তবুও,অঞ্চলভেদে খাবারের আইটেম আর পরিবেশনে বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। খাবারগুলোর স্বাদে-গন্ধে আর নামকরণেও আছে ভিন্নতা। খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা দেখা যায় আবহাওয়ার বৈচিত্র্যের কারণেও। এসবের পাশাপাশি সংঘাতপ্রবণ অনিশ্চয়তার কারণেও কোথাও কোথাও বদলে যায় রোজার সংস্কৃতি। সেসব বৈচিত্র্যের খানিকটা এখানে তুলে ধরা যাক কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা থেকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রমজান মানেই হলো শৃঙ্খলা, সংযম আর নানাবিধ ইবাদতে ব্যস্ত মুসল্লিদের দিনরাত। আর সেই শৃঙ্খলার কথা বললে প্রথমে আসে একজনের কথা। কাশ্মীরের ভাষায় যাকে বলে ‘সেহের খান’। সেহরীর সময় যিনি এক মুখ খোলা ঢোল (দফ) বাজিয়ে মানুষের ঘুম ভাঙান। ভাঙা ঢোলের দ্রিম দ্রিম শব্দের তালে তালে তিনি সজোরে আওয়াজ দেন, ‘ওয়াক্তে... সেহে...র’। অন্ধকারে ডাকতে ডাকতে তিনি হেঁটে চলেন পাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এলার্ম ঘড়ি কিংবা মাইকের আওয়াজ এখন আছে সবখানে। তবু, ‘সেহের খানের’ আওয়াজ ছাড়া যেন কাশ্মীরের রোজা অপূর্ণ। বিভিন্ন এলাকায় বংশানুক্রমিকভাবে দু-একটি পরিবারের লোক এ কাজ করেন। রমজান মাসে তিনি মসজিদে ঘুমান। তাঁর খানাপিনার ব্যবস্থা হয় মহল্লার সবার পক্ষ থেকে। রমজানের শেষে মহল্লার লোকদের কাছ থেকে তিনি পান বকশিশ। এ হলো কাশ্মীরের শত শত বছরের রেওয়াজ।
গত কয়েক বছরে আবার শোনা যাচ্ছে সেহের খানের কণ্ঠ। তাঁদের সেহরির ডাক কাশ্মীরের শান্তির পুনঃরুজ্জীবন বলে মানুষের বিশ্বাস। কয়েক বছরের কথা বলতে গেলে বলতে হবে,রমজান সেখানে শান্তিপূর্ণ। কর্মব্যস্ত দিন শেষে সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ফেরে সাধারণ মানুষ। তার পরই রাস্তায় নামে সুনসান নীরবতা। অন্য মাসের রাতের সেই নীরবতার ধ্যান ভেঙে খানিকটা সরবতা আসে রমজানে। মসজিদে তারাবিহর নামাজ হয়,দরুদ পড়া চলে। ভুল উচ্চারণে,সমস্বরে কাওয়ালির ঢঙে মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসে হামদ কিংবা দরুদের সুর। শত শত মুসল্লির কণ্ঠে ওই দুরুদ শুনলে মনে হবে,গোটা উপত্যাকার মানুষের দুঃখ-বেদনার কাহিনী সুরের মুর্ছনা জাগিয়ে খোদার কাছে উড়ে যাচ্ছে। শত শত মুসল্লি তাদের কণ্ঠের সবটুকুন দরদ ঢেলে দিয়ে পড়েন হামদ ইয়া... আ..র হামা..র রা..হিমি..ন। রমজানের শেষের দিকে রাতগুলোতে মসজিদগুলো হয়ে ওঠে আরো বেশি প্রাণোচ্ছল। আমাদের দেশে রমজানের আগের মাসে শবেবরাতে যেমন উৎসবের আমেজ দেখা যায় মসজিদে,কাশ্মীরের মসজিদে সেই আমেজ দেখেছি কদরের রাতগুলোতে। শেষ দশদিনের প্রতিটি বেজোড় রাতেই মসজিদগুলো খোলা রাখা হয় সারারাত।
সেহরি বা ইফতারির মধ্যে দু-একটা ছাড়া তেমন বিশেষত্ব নেই কাশ্মীরে। ইফতারির আইটেম হিসেবে খেজুরের আবশ্যকতা সবারই জানা। ফিরনি বা হালুয়া কাশ্মীরের মসজিদগুলোতে দেওয়া হয়। ইফতারির অনুষ্ঠানেও ফিরনি হলো আবশ্যিক। ঘিয়ে ভাজা চালের গুঁড়া ও সুজি দিয়ে তৈরি হয় ওই হালুয়া। বেশির ভাগ মানুষই ইফতারের পর পরই ভাত খায়। অনেকে পান করে নুন-চা। ইফতারে আরো থাকে বিভিন্ন শরবত। সবচেয়ে জনপ্রিয় শরবতের নাম ‘কান’ বা ‘বাবরি বিউল’।
এটি মূলত তুলাসির বীজ বা তোকমা দানা। যাকে আরবিতে বলে রায়হান। সম্রাট বাবরের শাহী শরবতের তালিকায় ছিল এই বীজ। তাই,কাশ্মীরিতে একে বলে বাবরি বিউল। সরল অর্থে বাবরের বীজ। এক পেয়ালা দুধ জ্বালিয়ে তার সঙ্গে চিনি, এলাচ,সামান্য জাফরান,শুকনো নারিকেলের গুঁড়া মিশিয়ে নিন। সঙ্গে যুক্ত করুন পানিতে কয়েক ঘণ্ট ভিজিয়ে রাখা তোকমা দানা। বাবরি বিউলের শীতল শরবত পরিবেশন করতে পারবেন। এ ছাড়া পেস্তাবাদাম, আলমন্ড,এপ্রিকর্ড, আখরোটসহ অন্তত ছয় রকমের শুকনো ফল মিশিয়ে তার সঙ্গে আঠালো কিছু একটা যুক্ত করে তৈরি হয় কাতিরা নামের আরেক ধরনের শরবত।
অন্যান্য এলাকার মতো কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলোও আয়োজন করে ইফতারের। সেখানে সাধারণের অংশগ্রহণ যৎসামান্যই। মাগরিবের আজানের আগে ঘরে ফিরতেই অভ্যস্ত ওখানকার মানুষ। তবে,কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বড় আকারে একটি ইফতারের আয়োজন হচ্ছে শ্রীনগরে। গত বছর তারা ১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাজুড়ে লাইন দিয়ে বসিয়ে রোজাদার নারী ও পুরুষকে ইফতার করিয়েছিল। বলা হয়েছিল এশিয়ার বৃহত্তম ইফতার। বিশাল ডাল লেকের তীর ঘেষে সূর্যাস্তের সময় রোজাদারদের দেওয়া হয়েছিল মুরগি-বিরিয়ানি,খেজুর আর জুস। তিন হাজারেরও বেশি লোক হাজির ছিল সেখানে।
কাশ্মীরিরা মাংস বেশি খায় এ কথা সবারই জানা। রমজানে মুরগি, খাসি ও ভেড়ার মাংসের বিক্রি বেড়ে যায়। অনেক সময় গরুর মাংসও পাওয়া যায়। তবে,স্বজনহারা যারা,আর যাদের সন্তান কিংবা স্বামী আজও ফেরেনি,ফিরবে কি না তাও অজানা, তাদের ইফতারি আর সেহরিতে ফুটে ওঠে হাহাকার। এমনিতেই,কাশ্মীরিরা দান-খয়রাতে উদার। কেউ সামনে এসে হাত পাতলে তারা সাধারণত ফিরিয়ে দেয় না। এ মাসে এতিমদের জন্য বিশেষভাবে চাঁদা ও সাহায্য আদায় হয়। ভিক্ষুকের সংখ্যা আমাদের দেশের মতো বেড়ে যায়। বিহার,উড়িষ্যা ও উত্তর প্রদেশ থেকে অনেকে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগরে ভিক্ষা করতে। মসজিদে শান্তির আশায় দোয়া হয়। তখন, সম্মিলিত কান্নার সুরে মোহভঙ্গ হয়ে পড়ে রাতের নিস্তব্ধতার। গোশতের আইটেম দিয়েই বেশির ভাগ বাড়িতে সেহরি খাওয়া হয় সেহের খানের ডাক শুনে। তার পরই ফজরের আজানের আগে প্রায় সব বাড়িতে চলে ঐতিহ্যবাহী লবণ-চা (নুন-চা) আর খেজুর খাওয়ার পর্ব। রমজান শেষে ঈদের বাজার জমে বটে,তবে আমাদের দেশের মতো এত উন্মাদনা দেখিনি। ঈদের আয়োজনে সেমাই কিংবা মিস্টির প্রচলন নেই সেখানে। আছে, বেকারি থেকে কেনা নানা রকমের বিস্কুট,কেক বা গরম গরম বাকরখানি। সঙ্গে চা কিংবা কেহওয়া। ঈদের দিনে গোশত আর সাদা ভাত পরিবেশন করা হয় দুপুরে বা রাতে।