হজের খুতবায় যা বললেন শায়েখ ড. মাহের বিন হামাদ
আরাফার ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দিয়েছেন পবিত্র মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়েখ ড. মাহের বিন হামাদ আল মুয়াইকিলি। বাংলাদেশ সময় বিকেল সোয়া ৩টায় হজের খুতবা শুরু করেন তিনি। খুতবায় তিনি বলেন, হে মানুষ, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করো। কোরআনে বলা হয়েছে, যে অন্যায় করবে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন। খুতবায় তাকওয়ার জীবন অবলম্বনের তাগিদ দেন তিনি। এ ছাড়া ইসলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে মুসলমানদের পরিশুদ্ধ জীবন-যাপনের প্রতিও তাগিদ দেন। একইসঙ্গে সব কাজে ইসলামের বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দেন।
খুতবায় শায়েখ মাহের বিন হামাদ বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি প্রজ্ঞাময়, সমস্ত বিষয়ে অকিবহাল, মহাজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান। তিনি দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেছেন; তারা একে অন্যকে দ্রুত গতিতে অনুসরণ করে। আর সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্ররাজী—এরা সবই তাঁরই আজ্ঞাবহ। জেনে রেখো, সৃষ্টির একমাত্র কর্তা তিনিই। হুকুমের একমাত্র মালিকও তিনি।
খুতবায় আরও বলা হয়, আল্লাহ হলেন সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক, সৃষ্টির জন্য রহমতসরূপ এবং সৃষ্টির অবস্থান সংশোধনের জন্য তিনি পবিত্র আল কোরআন নাজিল করেছেন। ‘এটি এমন কিতাব, যার আয়াতগুলো সুদৃঢ়, অতঃপর মহাজ্ঞানী মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে স্ববিস্তারে ব্যাখ্যাকৃত। এই কোরআন সঠিক পথের দিশা দেয় এবং সৎকর্মশীল মুমিনদের এই সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার।’ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহা নেই, তিনি ব্যাতীত কারও ইবাদত করা যায় না। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।
খুতবায় পবিত্র মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব বলেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর অনুগ্রহগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, তিনি মানবজাতীকে কল্যাণের পথে নিতে তাদের কাছে মুহাম্মদ (স.)-কে পাঠিয়েছেন।
শায়েখ ড. মাহের বিন হামাদ পবিত্র কোরআনের আয়াত উল্লেখ করেন। যেখানে আল্লাহ বলেছেন—আমার দয়া ও অনুগ্রহ প্রতিটি বস্তুকেই পরিবেষ্টন করে আছে। সুতরাং, যারা তাকওয়া অর্জন করে, যাকাত দেয় ও আমার আয়াতসমূহের প্রতি ইমান আনে, তাদের জন্য অচিরেই আমি আমার অনুগ্রহ অবধারিত করব।
ড. মাহের বিন হামাদ শয়তানের প্রবঞ্চনা থেকে বেঁচে থাকতে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তাকওয়ার অধিকারী হয়, তিনি দুনিয়া ও আখিরাতের উত্তম পরিণাম এবং নিশ্চিত বিজয় লাভ করেন।
একপর্যায়ে ড. মাহের বলেন, তাওহিদের সাক্ষ্যের সঙ্গে রিসালাতের সাক্ষ্য অন্তর্ভূক্ত হয়। কারণ, হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর রাসুল। আল্লাহ বলেছেন, ‘মুহম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী।’ তাওহিদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য ইসলামের রোকনগুলোর মধ্যে সর্ব প্রথম রোকন বা স্তম্ভ। ইসলামের স্তম্ভের মধ্যে আরও রয়েছে—পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করা। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন, নিশ্চয় নামাজ সব ধরনের অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ ইসলামের আরেকটি রোকন হলো যাকাত আদায় করা। আল্লাহ রমজানের রোজাকে ফরজ করেছেন। এটাও ইসলামের একটি রোকন। এটিকে আল্লাহ ‘হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর যার সক্ষমতা রয়েছে, তার জন্য হজ পালন করা ইসলামের আরেকটি রোকন।
খুতবায় বলা হয়, পরিষ্কার অবস্থান থেকে বরকতময় ইসলামি শরিয়াহ কল্যাণ অর্জন ও তা বৃদ্ধি করা এবং অকল্যাণ দূরীকরণ বিষয়টি নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি ইসলামি শরীয়াহ বলেছে যে, অকল্যাণ প্রতিহত করা কল্যাণ অর্জনের চেয়ে অগ্রগামী। একইভাবে বড় কল্যাণের জন্য ছোট কল্যাণ ত্যাগ অথবা বড় ক্ষতি রোধ করার জন্য ছোট ক্ষতি মেনে নেওয়ার মূল নীতি নিয়ে এসেছে ইসলাম। একইসঙ্গে একাধিক বিষয় এসে উপস্থিত হলে সব থেকে সব থেকে বড় কল্যাণ ও সব থেকে ছোট ক্ষতি গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এভাবে ইসলাম আরও গুরুত্ব দিয়েছে যে, একটি ক্ষতি দূর করতে গিয়ে আরেকটি ক্ষতি করা যাবে না। হাদিসে এসেছে—ক্ষতি করাও যাবে না, ক্ষতিগ্রস্তও হওয়াও যাবে না। সুতরাং, যথাসম্ভব ক্ষতি রোধ করতে হবে। এভাবে ইসলামি শরিয়াহ জীবনকে সমৃদ্ধ করার বিধান নিয়ে এসেছে, যার দ্বারা উন্নতি সাধিত হবে। আমাদের শরিয়াহ অন্যকে ক্ষতি করা থেকে এবং কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি আদেশ দিয়েছে, ন্যায়নীতির উত্তম চরিত্র, পিতামাতার প্রতি সদাচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, সত্য কথা বলা, অধিকার সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে হকদারের কাছে আমানত পৌঁছে দেওয়া, আমানত আদায় করা, চুক্তি রক্ষা করা এবং শাসকের কথা শোনা ও তাদের আনুগত্য করা ইত্যাদি বিষয়ের।
খুতবার একপর্যয়ে ড. মাহের বলেন, একজন মুমিনের উচিৎ, ইসলামের পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ের হেফাজত করা। এর মাধ্যমে তার চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ও জীবনের পরিস্থিতি রক্ষিত হবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তার ধর্ম ও দুনিয়ার স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হবে। আর এজন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষকে একে অপরের সহযোগিতা করা দরকার।
ড. মাহের বলেন, হজ দ্বীনের নিদর্শন ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পাবে, এটাই স্বাভাবিক। হজ রাজনৈতিক দলীয় স্লোগান, প্রতীক ও চিহ্ন ব্যবহারের জায়গা নয়। এখানে নির্ধরিত কর্তৃপক্ষের নিয়মশৃঙ্খলা ও নির্দেশনা মেনে চলা আবশ্যক যেন নিরাপদে ও সুষ্ঠুভাবে পবিত্র হজের কার্যাবলী সম্পাদন সম্ভব হয়, যেন হাজি সাহেবরা অত্যন্ত নিরাপত্তা ও প্রশান্তির সঙ্গে তাদের কাজগুলো করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর ঘরে সম্মানিত হাজি সাহেবরা, নিশ্চয় আপনারা আরাফায় এমন একটি সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন, যার জন্য ফেরেশতারা আপানাদের নিয়ে আল্লাহর কাছে গর্ব করেন।
ড. মাহের হাজ পালনকারীদের উদ্দেশে বলেন, একটি মহিমান্বিত ও বরকতময় সময়ে আপনারা একত্রিত হয়েছেন। এখানে ভালো কাজের প্রতিদান বহুগুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়, পাপ কাজগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, বান্দার মর্জাদা বৃদ্ধি করা হয়। কাজেই রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সপর্দ করুন। সেই নবীকে অনুসরণ করুন, যিনি এই সম্মানজনক স্থানে সাহাবিদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। বেলাল (রা.)-কে নির্দেশ দিলে তিনি আজান ও ইকামত দেন। পরে রাসুল (সা.) দুই রাকাত জোহরের নামাজ আদায় করেন। এরপর ইকামত দেওয়া হলে রাসুল (সা.) আসরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। মুলত, দুই সালাতকে একত্রিক করা এবং অগ্রবর্তী করে আদায় করার একটি বিধান। অতঃপর তিনি উটের পিঠে বসেন। সেই অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করেন, যতক্ষণ সূর্যের লাল আভা বিলীন হয়ে যায়। পরে তিনি মুজদালিফায় যাত্রা করেন। পথিমধ্যে সাহাবিদেরকে বিনয়, নম্রতা ও সহনশীলতার নির্দেশ দেন। মুজদালিফায় পৌঁছে তিন রাকাত মাগরিবের ও দু’রাকাত এশার নামাজ আদায় করেন। ফজরের নামাজ আদায় না করা পর্যন্ত সেখানে রাত যাপন করেন। ভোরের আলো পরিস্ফুটিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে দোয়া করতে থাকেন। পরে মিনার দিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌঁছে জামারায় সাতটি ছোট পাথর নিক্ষেপ করেন। অতঃপর কোরবানির পশু জবেহ ও মাথা মুণ্ডন করেন। এরপর বায়তুল্লায় হজের ফরজ তাওয়াফ সম্পন্ন করেন। তাওয়াফ শেষে আবার মিনায় ফিরে আসেন। তাশরিকের দিনগুলোতে প্রচুর পরিমাণে তিনি তাকবির, তাহলিল ও তাহমিদের মাধ্যমে আল্লাহর জিকির করার মধ্য দিয়ে অবস্থান করেন। প্রতিদিন দ্বিপ্রহরে তিনি তিনটি জামারায় তিনি পাথর নিক্ষেপ করেন। ছোট ও মধ্য জামারাতে পাথর মেরে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। আর অক্ষম ও অপারগদের জন্য মিনায় অবস্থানের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
ড. মাহের বলেন, ১২ জিলহজে মিনা ত্যাগের অনুমতি রয়েছে, তবে ১৩ তারিখ পর্যন্ত থাকা সুন্নাহ। হজের যাবতীয় কাজ শেষে মদিনায় ফিরে যাওয়ায় মনস্থ করলে রাসুল (সা.) পবিত্র কাবা ঘরে বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করেন।
খতিব বলেন, আপনারা নিজেদের জন্য, নিজেদের নিকটস্ত যারা আছেন তাদের জন্য দোয়া করুন। কারণ, কারও জন্য দোয়া করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতারা বলেন আমিন, তোমার জন্যও একই পুরস্কার। খতিব আরও বলেন, আমাদের আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের জন্য দোয়া করুন। যারা ভয়াবহ বিপদে আক্রান্ত রয়েছেন, শত্রুদের হামলায় ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাদের রক্ত ঝরানো হয়েছে, তাদের ভূমিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, খাবার, ওষুধ, পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাদের কাছে পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না।
নিশ্চয় যারা পরের উপকার করে এবং অন্যের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করে, আমাদের দোয়া পাওয়ার বিষয়ে তারা বেশি হকদার। যারা হারামাইন শরিফাইনের খেদমতে আছেন এবং আল্লাহর ঘরের মেহমানদের কষ্ট লাঘবে রাতদিন নির্ঘুম অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের কথা বলতেই হবে। আর এই শ্রেণির ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বপ্রথমে আসে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এবং তার বিশ্বস্ত ক্রাউন প্রিন্সের কথা। হে আল্লাহ, হে চিরঞ্জীব, হে মহান স্বত্ত্বা, হে অতি সম্মানের অধিকারী রব, আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনার দয়া ও অনুগ্রহে খাদেমুল হারামাইন শরিফাইনের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ তার বিশ্বস্ত ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজের তৌফিক দান করুন। তাদের জন্য আপনি সাহায্যকারী হন, তাদের প্রতিদান বৃদ্ধি করে দিন এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, তাদের খেদমতগুলোকে কবুল করে নিন। তারা ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত করছে, আল্লাহ তাদের সওয়াবকে আপনি বাড়িয়ে দেন, তাদের ক্ষমা করুন।
শায়েখ ড. মাহের বিন হামাদ বলেন, হে আল্লাহ, আপনি হাজি সাহেবদের হজকে কবুল করুন। তাদের কাজকে সহজ করে দেন। সয়িহ সালামতে প্রভূত কল্যাণের মধ্য দিয়ে গোনাহ মুক্ত হয়ে কবুল তওবার সৌভাগ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে যেন তারা নিজ নিজ দেশে পৌঁছে যেতে পারেন, সেই তৌফিক দান করুন। হে আল্লাহ, সব মুসলিম নরনারীকে ক্ষমা করুন। সব অনিষ্ট থেকে তাদের রক্ষা করুন। তাদের দ্বীন ও নিরাপত্তাকে, রক্ত ও সম্পদকে, তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও মানসম্মানকে হেফাজত করুন। তাদের জন্য কল্যাণ দিন। তাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করুন। তাদের ভূখণ্ডকে নিরাপদে রাখুন, অভাব থেকে মুক্ত রাখুন, তাদের সব বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করুন। তিনি আরও বলেন, হে আল্লাহ, আপনি মুসলমানদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করুন। মুসলমানদের ভূখণ্ডকে নিরাপদে রাখুন, তাদের রিজিকে বরকত দিন এবং তাদের সব বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করুন।