রম্য
ইলিশ যার যার বৈশাখ সবার
১
বসে বসে ভাবছি, ‘আগে গরিব মানুষ বাধ্য হয়ে পান্তা খেত, এখন পান্তা খেতে গিয়ে গরিব হতে হয়।’ আরে খাইছে। অ্যারিস্টটল হয়ে গেলাম নাকি? যেটা অ্যারিস্টটলের বলার কথা সেটা কি না আমি বলে দিচ্ছি? ইয়াহু!
ভাবনায়, ছেদ পড়ল। বউ বাজারের ব্যাগ মুখের ওপর ছুড়ে মারল অর্ডারসহ, ‘অনেক ভেল্কিবাজি দেখাইছো, এবার বাজারে যাও।’
থতমত খেয়ে বললাম, ‘বাজারে তো যামুই, বাজারে না গেলে তোমার নববর্ষ শুভ হবে? আমারটা তো গেলেও হবে না, না গেলেও হবে না।’
“পয়লা বৈশাখে পুরান কিছু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনকেও দাওয়াত করেছি, এবারের ইলিশের সাইজ যদি তোমার মতই ‘লিলিপুট’ হয়, তাহলে তোমার একদিন আমার যে কয়দিন লাগে।”
এতক্ষণ তাও লাইনে ছিল, ধীরে ধীরে দেখি বেলাইনে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তার একটাই উপায়, বউ যা বলে মেনে নেওয়া। আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ‘তোমার কথায় নয়, নিজের ইচ্ছায় বাজারে যাচ্ছি’ এমন একটা লুক এনে বের হলাম। গতবার ইলিশের সাইজ একটু ছোট হয়ে গিয়েছিল বলে শালা-শালিরা আমায় খেপায় ‘জাটকা দুলাভাই’ বলে। এবার দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে। পারলে তিমি সাইজের ইলিশ কিনব। শালার কত কিছুই হাইব্রিড বের হচ্ছে, ইলিশের কোনো হাইব্রিড নেই। ভাবতে ভাবতে বাজারে চলে এলাম।
—কিরে, ইলিশের সাইজ এত ছোট কেন?
—স্যার, গ্ল্যামার সচেতন ইলিশ, তাই একটু স্লিম মনে হচ্ছে, বৈশাখ তো এখনো দুদিন বাকি। বাসায় নিয়ে নিয়ম করে কমপ্লান খাওয়ান। দেখবেন, পছন্দমতো সাইজ হয়ে গেছে। বলে দাঁত বের করে হাসতে লাগল দোকানদার।
বউয়ের ঝাড়ির ওপর মাছ বিক্রেতার জ্ঞান বিতরণ। মেজাজ বিগড়ে গেল। কিচ্ছু করার নাই। কবি বলেছেন, রাগলেন তো হেরে গেলেন। নিজেকে ধমকাই, কুল কু-ল।
—দাম কত?
—সবাইরে যে দাম কইছি, আপনারে তা কমু না। আপনে হচ্ছেন গিয়া বউনির কাস্টমার, তার ওপর সম্মানী লোক।
—হইছে, কত দিতে হবে সেটা বলো।
—স্যার, দেহেন আমনের দিকে কেমন চাইয়া রইছে। এইডা খাডি পদ্মার ইলিশ। লগে সার্টিফিকেট আছে।
—ইলিশের লগেও সার্টিফিকেট?
—হ স্যার, যেই জেলে ধরেছে তার সার্টিফিকেট। দেহামু?
—হইছে, দেখন লাগবে না, দাম কত?
—স্যার, সবার কাছে কি আর সব রকম দাম চাওয়া যায়? প্রতি পিস ১৬ হাজার টাকা স্যার। দোকানি এমনভাবে বলছে যেন ১৬ হাজার টাকা টাকাই নয়। কাগজ কুড়িয়ে বেচলেও দিনে ১৬ হাজার টাকা কামানো যায়।
—কত?
—১৬ হাজার স্যার।
মাথা কেমন জানি ঝিমঝিম করে উঠল। যেদিকে তাকাই হলুদের ক্ষেত। এই ব্যাটায় ১৬ হাজার টাকা একসঙ্গে জীবনে দেখেছে কি না, তা-ও সন্দেহ। ভাবছি, আগামীবার ইলিশের ব্যবসায় নেমে পড়ব। কিছু একটা দাম বলতে হবে। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে আমিও দাম বললাম।
—১৬শ টাকা হবে?
—স্যার কি মশকরা করেন? ১৬শ টাকায় পুঁটি মাছ পাইলে পাইতে পারেন। এক ব্যাগ পুঁটি কিইনা লইয়া যান। ম্যাডাম কি আর অত চিনব?
বাসায় এসে ব্যাগ ধরিয়ে দিলাম। হোম মিনিস্টার জরুরি কাজে বিজি। ব্যাগ খুলে দেখার টাইম পেল না। আমিও এটাই চাইছিলাম। যত দ্রুত সম্ভব বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হবে। কার বাসায় যাওয়া যায়, সেটা ভাবছি। ১৬ হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ কিনলে সঙ্গে পান্তার ব্যবস্থা আর হবে না। বাকি মাস তো পড়েই আছে। মাছ বিক্রেতার বুদ্ধিটাই কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। ১৬শ টাকায় ব্যাগভর্তি পুঁটি মাছ কিনেছি। ইলিশ কিনতে পারি নাই বলে যে আমার বাসায় পয়লা বৈশাখ আসবে না, এমন তো আর না। কে যেন বলেছেন, ইলিশ যার যার বৈশাখ সবার।
মানুষ কত জোচ্চুরি করে, ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়, রডের বদলে বাঁশ দিয়ে ছাদ ঢালাই দেয়। আমি না হয় আপন বউয়ের সঙ্গে একটু বাটপারি করলাম। সে যদি বুঝতে না পারে, তাহলে আমার চেয়ে সুখী স্বামী এবারের পয়লা বৈশাখে পাওয়া যাবে না।
আর যদি বুঝতে পারে...? বুঝলে কী? সে জন্যই তো ব্যাকআপ রেখেছি। বন্ধু আবীরের বাসায় চলে যাব। রাতে ফোন দিয়ে ঝড়ের গতি নির্ণয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
বউ রান্নাঘরে ব্যাগ খুলছে। অফিসের জরুরি ফোন এসেছে, এমন ভাব ধরে মোবাইল কানে নিয়ে বের হয়ে এসেছি। বউয়ের ভয়ে ঘর না ছাড়লে অ্যারিস্টটল হওয়া যায় না।
আমি এখন সিঁড়িতে। আর একতলা নামলেই বাড়ির গেট। গেট পার হতে পারলেই এ যাত্রায় রক্ষা। সারা বাড়ি থরথর করে কাঁপছে। ওপরে ‘অ্যাভেঞ্জার্স’ মুভির শুটিং শুরু হয়েছে মনে হয়। আমার বউ হালকের পার্ট করছে। সামনে যাকে পাবে পুঁটি মাছের মতো গিলে খাবে। পালাতে পালাতে অবিবাহিত পুরুষদের একটা উপদেশ দিয়ে যাই, ‘চালাক মেয়েকে বিয়ে কইরেন না।’