শচীন যেন সাহিত্যের মায়াজাল কিংবা রংতুলিতে আঁকা শান্ত ঢেউ

Looks like you've blocked notifications!
শচীন টেন্ডুলকার। ছবি : শচীনের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

একদিনের ক্রিকেটে ব্যক্তিগত ২০০ রান এখন আর কল্পনা নয়। মারকাটারি ক্রিকেটের যুগে ব্যাট চালিয়ে রান তোলাটাই মূখ্য। শুদ্ধ ব্যাকরণে নিজেকে বাঁধতে চাওয়াদের সংখ্যা অল্প। সেই অল্পদের গল্পের অনেকখানি জুড়ে একটি নামের বিচরণ। 'শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।' ক্রিকেট দেবতা ছোট্টো শচীনের কাঁধটাকে ভীষণ মজবুত করে পাঠিয়েছেন। যখন খেলতে নামতেন, বাকিরা নামতো দলের জন্য। শচীন নামতেন দেশের জন্য। কাঁধে নিয়ে শত কোটি ভক্তের প্রত্যাশার চাপ ।

১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল জন্মেছিলেন। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন প্রখ্যাত মারাঠি ঔপন্যাসিক। কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শচীন দেব বর্মনের ভক্ত ছিলেন। তার নাম অনুসারেই রাখেন সন্তানের নাম। ঠিক পঞ্চাশ বছর পর, শচীনের নামে এখনও অনেকে সন্তানের নাম রাখে। তবে সেই শচীনটা দেব বর্মন নয়, টেন্ডুলকার। ভারতের তেরঙ্গাকে বাইশ গজের ময়দানে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা সম্ভাব্য প্রথম সুপার হিরো।

শচীনের আগেও অনেক হিরো এসেছিলেন ভারতের ক্রিকেটে। শচীনের পরেও অনেকেই আছেন। ১৯৮৩ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপের স্বাদও পেয়েছিল ভারত। কিন্তু লিটল মাস্টার যখন থেকে মাঠে নিজের পদচিহ্ন আঁকতে শুরু করেন, হয়ে ওঠেন খেলাটার পরিপূরক। নামে লিটল মাস্টার হলেও কীর্তিতে তিনি বিগেস্ট হেডমাস্টার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অসংখ্য প্রথমের জন্ম দেওয়া শচীন মাঠের ক্রিকেটে যতটা আগ্রাসী, মাঠের বাইরে ততটাই শান্ত।

মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শচীন যেন বাইশ গজে গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের সাহিত্য, হুডিনির মায়াজাল, ভ্যান গগের রংতুলির মিশেলে তৈরি শান্ত এক ঢেউ। যে ঢেউয়ের ভেলায় ভেসে যেতে চায় সকলে। প্রায় দুই যুগের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যার কোনো সমালোচক ছিলেন না, যাকে কেউ অপছন্দ করতেন না। ২০১১ সালের বিশ্বকাপটা ভারত মনপ্রাণ দিয়ে জিততে চেয়েছিল শুধু এই একটি মানুষের জন্য। যে মানুষ নিজের বিনয় নিয়ে অনায়াসে বলতে পারেন- 'আমি নম্র, সহজ, সরল হওয়ার মানে এই নয়, আমি আত্মবিশ্বাসী নই। আমি নিজের ভেতর সরলতাকে লালন করি এবং এগিয়ে চলি'; তার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে দুবার ভাবতে হয়নি ভারতীয়দের।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬ বছর বয়সে অভিষেক থেকে ২০১৩ সালে শেষ করার আগ পর্যন্ত ক্রিকেটের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি ছিল শচীনের। দু'জন দু'জনকে নিঃস্বার্থভাবে ততটা দেবেন, যতটা উজাড় করে দেওয়ার পরেও মনে হবে, কিছুই তো দেওয়া হলো না!

ক্যারিয়ারে ঠিক ২০০টি টেস্ট খেলে থামেন শচীন। সাদা পোশাকে করেন ১৫ হাজার ৯২১ রান। যেখানে সেঞ্চুরি ছিল ৫১টি আর হাফসেঞ্চুরি ৬৮টি। ওয়ানডেতে শচীন খেলেন ৪৬৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ৪৯টি সেঞ্চুরিতে রান করেন ১৮ হাজার ৪২৬। হাফসেঞ্চুরি করেন ৯৬টি। ২৪ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৬৬৪ ম্যাচ খেলে করেছেন মোট ৩৪৩৫৭ রান করেছেন ভারতের এই ব্যাটিং জিনিয়াস।

শচীন মাঠে মানা নামে উৎসবে ছেঁয়ে যাওয়া। অসি ক্রিকেটার ম্যাথু হেইডেন বলেছিলন, 'আমি ঈশ্বরকে দেখেছি। তিনি টেস্টে ভারতের হয়ে চারে ব্যাট করেন।' শচীনের জন্মদিনে আজ ভারতজুড়ে উৎসব। অথচ তিনি বরাবরের মতোই সরল। এত এত রেকর্ড গড়েও নির্বিকার থাকতেন তিনি। বলেছিলেন, 'আমার অর্জন নিয়ে আমার পরিবার কখনোই মাতামাতি করে না। মিষ্টি কিনে আনি এরপর সামনের দিকে পা বাড়াই। সবাই যখন আমার শেষ ম্যাচ নিয়ে কথা বলে, আমি তখন নজর রাখতাম সামনের ম্যাচে।'

এই মানুষটা সফল না হলে সফলতা শব্দটিও হয়তো লজ্জায় নতজানু হতো। এখন যেমন শ্রদ্ধায় নতজানু হয়। প্রত্যাশার চাপ সামলে যিনি হয়ে উঠেছিলেন মহাকাশ, বর্ণিল আভায় রাঙিয়েছেন গোটা ক্রিকেট দুনিয়া। হাসিমুখের সেই শচীনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।